হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পল্লবী সেন

রোমাঞ্চের খোঁজে পাহাড়ি পথে হেঁটে চলার নামই ট্রেকিং. আর যে কোন ট্রেকারদের কাছেই স্বপ্নের গন্তব্য হলো জংরি গোচা লা ট্রেক, যা ভারতের অন্যতম কঠিন ট্রেকগুলির একটি। পাহাড়ের প্রতি অমোঘ টান আর ভালোবাসার থেকেই ব্যস্ততম শহর কলকাতা থেকে বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপূজা ছেড়ে আমরা ৭ বন্ধু রওনা দিয়েছিলাম পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্প - এই গোচা লা পৌঁছাবো বলে। 

কিন্তু রওনা দেওয়ার পথে বাধ সাধলো বৃষ্টি। প্রায় মাস চারেক আগে থেকে সমস্ত প্ল্যানিং শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের কিন্তু রওনা দেওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসতে থাকলো গুগলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে আমাদের চিন্তা বাড়তেই থাকলো। এবছর বৃষ্টির মরসুম বেশ কিছুদিন পিছিয়ে যাওয়ার কারণে সেপ্টেম্বরে বর্ষা বিদায় না নিয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টি চলল। যার ফলে আমাদের এই ট্রেকে যাওয়ার অনিশ্চয়তা দেখা দিল। মনের মধ্যে অনেক দ্বিধা নিয়ে আমরা ট্রেকিং এর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কেনাকাটা করতে থাকলাম। অবশেষে বৃষ্টির মোকাবিলা করতে হবেই জেনে সমস্ত রকম সাবধানতা অবলম্বন করে মনে উত্তেজনা আর অনেকটা জোর নিয়ে রওনা দিলাম আমরা সাতজন।

শিয়ালদহ স্টেশনে সকলে একত্রিত হয়ে রাতে ট্রেনে চেপে রওনা দিলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পরের দিন সকালে নেমে একটু ফ্রেশ হয়ে নেবার পালা কারণ যেতে হবে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে ৫৮৪০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত ভারতের সবচেয়ে কম জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাজ্য সিকিমের প্রাচীন রাজধানী ইউকসম এ। পাহাড়ে একটানা বৃষ্টির কারণে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল এবং পর্যটকদের জন্য অহরহ ওই পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। তবে আমরা সদ্য বৃষ্টির ফলে রাস্তায় নামা ধ্বসের চিহ্ন ও রাস্তা মেরামতির কাজ দেখতে দেখতে দশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরেই এগিয়ে চললাম ইউকসমের দিকে। প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘন্টা লেগে গেল পৌঁছতে কারণ মাঝপথ থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল মুষলধারে। আবহাওয়ার খবর শুনে সকলেরই পরিবারের লোকজন আবহাওয়া বুঝে ট্রেক শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন ফোনে। আমরাও কয়েকজন বেশ কিছুটা হতাশা ও নেতিবাচক মনোভাব নিয়েই রাত্রে ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু পরের দিনের রোদ ঝলমলে আকাশ দেখে আমরা চটজলদি ট্রেক শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য সাচেন এর উদ্দেশ্যে। আমাদের সমগ্র ট্রেকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বসন্ত এডভেঞ্চার্স বলে একটি ট্রেকিং অপারেটর গ্রুপ। গাইড, একজন রাঁধুনী ও পোর্টার সহ আমাদের সাতজনের টিম ১১ জন হয়ে গেল ইউকসম থেকে। 

আমাদের হিরো রা..

অপূর্ব সুন্দর নানান ফুলে সাজানো ও বৌদ্ধ মনেস্ট্রিতে ঘেরা ইউকসম ছেড়ে পরবর্তী সমস্ত জার্নি কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে যা ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এর তকমায় ভূষিত হয়েছিল। অপূর্ব সুন্দর জীববৈচিত্র্যে ভরা এই ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে চড়াই ভেঙে প্রায় ৭৬০০ ফিট উঠে পৌঁছলাম সকলে সাচেন নামক জায়গায়। পথে পড়ল নাম না জানা অজস্র ঝর্ণা যেগুলি পার হতে কিছু জায়গায় বেশ বেগ পেতে হল আমাদের। আজ ৭ কিলোমিটার পাহাড় চড়লাম ৫ ঘণ্টার মধ্যেই। প্রতিদিনই ট্রেকিং করে পৌঁছানোর পর আমাদের আদা দিয়ে গরম চা ও গরম গরম স্যুপ পান করতে দেওয়া হতো। সাচেনে পৌঁছে জীবনের প্রথম একটি অভিজ্ঞতা পূরণ করলাম জঙ্গলের মধ্যে তাঁবুতে থেকে। আমাদের যাত্রা পথে সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও সন্ধ্যে থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়, যা সারারাত ব্যাপী চলে। তাঁবুর ভেতরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে বিদ্যুৎ বিহীন এক বৃষ্টিমুখর রাত যে কতটা উত্তেজনায় কাটিয়েছিলাম তা সারা জীবন ভোলার নয়।

আহা! প্রথম তাঁবুর স্বাদ!! সাচেন ক্যাম্পসাইট

পরদিন সকাল থেকে পুনরায় ঝকঝকে পরিষ্কার আবহাওয়াকে সঙ্গী করে পাহাড়ি পথ ভেঙে ওঠার কাজ শুরু হয় আমাদের, এদিনের গন্তব্য শোকা। যেতে হবে প্রায় ১০০০০ ফিট উচ্চতায়। মাঝে গত রাতে বৃষ্টির ফলে সদ্য নামা এক বিশাল ধ্বসের উপর দিয়ে নড়বড়ে বোল্ডারে অত্যন্ত সন্তর্পনে পা ফেলে এগোতে হল আমাদের। ভাগ্যক্রমে ট্রেক করার সময় আবহাওয়া আমাদের সঙ্গ দিয়েছিল না হলে এই কঠিন বোল্ডার ও নানা চ্যালেঞ্জে ভরা এই ট্রেক রুট বৃষ্টির মধ্যে অতিক্রম করা এক রকম অসম্ভব হয়ে পরতো। সাচেন থেকে শোকা যাওয়ার পথটি ভারী সুন্দর, কাঠের গুঁড়ি দিয়ে কার্পেটের মতো বিছানো সমগ্র রাস্তা আর দু'ধারে রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল। জঙ্গলের পথ যে এত দৃষ্টিনন্দন হয় তা এই পথে না এলে জানা যায় না। 

দু পাশে রডোডেনড্রন ও গাছের গুঁড়ি বিছানো রাস্তা

পথের ধারে ফুল ও লতা পাতার সমারোহ

চারিদিকে সবুজ স্যাঁতস্যাঁতে ছোট বড় নানা রকম ফার্ণ ও শ্যাওলা জমে থাকা গাছের গুঁড়ি মাঝেমধ্যেই আমাদের ছবিতে দেখা অ্যামাজন এর জঙ্গলের কথা মনে করাচ্ছিল। মাঝে বাখিম  নামের ছোট্ট বিশ্রাম স্থল পেরিয়ে শোকা পৌঁছলাম কিন্তু শোকা পৌঁছানোর ঠিক মিনিট ১৫ আগে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি হল জঙ্গলে। চোখের সামনে আমরা কয়েকজন চুপ চাপ দাঁড়িয়ে দেখলাম বিখ্যাত রেড পান্ডা সামনের বিশাল গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফালাফি করছে। আমাদের গাইড বললেন যে আমরা নাকি খুব লাকি কারণ উনি নিজেও এত বছরে এই রেড পান্ডা দেখতে পাননি। শোকা যখন পৌঁছলাম তখন চারপাশ মেঘে আচ্ছন্ন। উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের গাইড ভাই লাঞ্চের পর তাঁবুতে রেস্ট না নিয়ে আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বললেন । সুন্দর একটি মনেস্ট্রী ও সামনের ছোট লেকের চারপাশে হেঁটে হেঁটে দূরের পাহাড় গুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম আমরা। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে আকাশে যেন নেমে এলো কোটি কোটি তারার মেলা । খালি চোখে সৌরজগতের মিলকিওয়ে পরিষ্কার দেখতে দেখতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনার সম্পন্ন করে তাঁবুর ভেতরে চলে যেতে হল কারণ যত ভোরে উঠতে পারব ততই দূরে পাহাড়ের স্বচ্ছ ভিউ পাবো। 

পরের দিন ভোর পাঁচটায় তাঁবু খুলতেই চোখের সামনে ধীরে ধীরে মাউন্ট পান্ডিম ও হিমালয়ের অন্যান্য রেঞ্জগুলো সূর্যোদয়ের ফলে সোনালী আলোয় আলোকিত হতে থাকলো। মন ভালো করা সেই সকালের রেশ সাথে নিয়ে শুরু করলাম আজকের ট্রেক- গন্তব্য জংরি। শোকা থেকে জংরির এই পথ বোধ করি এই ট্রেকিং এর সব থেকে কঠিন পথ কারণ প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে চড়াই পেরোতে হলো আমাদের। ‌এই পথে রডোডেনড্রনের জঙ্গল সবচেয়ে ঘন, এপ্রিল মে মাসে এখানে নিশ্চয়ই রডোডেনড্রন ফুলের নানা রঙের হোলি খেলা চলে। আজকের পথের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে হয়ে দাঁড়ালো অনেকটা উচ্চতা ওঠার কারণে হাই অলটিটিউড মাউন্টেন সিকনেস। ক্রমশ মাথা যন্ত্রণা ও মাঝে মাঝে বমি ভাব এই নিয়েই পথ চলতে চলতে ১৩ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ১৩,২৬৫ ফিট উচ্চতায় জংরি পৌঁছলাম যখন ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে। মাউন্টেন সিকনেস এর কথা শুনে আমাদের রাঁধুনি দাদা শীঘ্রই গরম স্যুপ ও সদ্য ভেজে আনা পপকর্ন খেতে দিলেন যা শরীরকে অক্সিজেনের মাত্রা ব্যালেন্স রাখতে সাহায্য করে। ‌দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। এত উচ্চতায় মেঘাচ্ছন্ন চারপাশের বিস্তৃত উপত্যকার পরিবেশে শীত ক্রমশ জাঁকিয়ে বসলো। এই প্রথম পাহাড়ি কনকনে ঠান্ডার আমেজ নিতে নিতে গরম গরম ডিনার সেড়ে নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হল আমাদের কারণ আগামীকাল এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চলেছিলাম আমরা। ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে অন্ধকারে মাথায় হেড টর্চ নিয়ে দেড় কিলোমিটার চড়াই ভেঙে পৌঁছতে হবে জংরি টপ ।এই প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ সবকটা রেঞ্জের ৩৬০° ভিউ এর আস্বাদ পেতে চলেছিলাম আমরা।‌  

যথারীতি পরের দিন মাঝরাতে অন্ধকারে ট্রেক শুরু করে এক পা, দু পা করে হেঁটে হেঁটে অত্যন্ত খাড়াই জংরি টপ পৌঁছে এক অকল্পনীয় সূর্যোদয়ের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম আমরা। ওই দৃশ্য আমি লিখে বর্ণনা করতে পারব না। প্রায় দু'ঘণ্টা জংরি টপে কাটিয়ে আবার অত্যন্ত সাবধান হয়ে নিচে নেমে এসে জল খাবার খেয়ে রওনা দিলাম পরের গন্তব্য থাংসিং এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ১২,৯০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত পশ্চিম সিকিমের একটি অনন্য সুন্দর উপত্যকা যাকে ঘিরে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয়ের পর্বতশ্রেণী যার একটি অন্যতম হলো মাউন্ট পান্ডিম। জংরি থেকে থাংসিং যেতে উচ্চতার কিছুটা অবনতি হয় ঠিকই কিন্তু মাঝে পেরোতে হয় সর্বোচ্চ গতিতে থাকা পশ্চিম সিকিমের এক প্রধান নদী প্রেক চু। 

এই পথের প্রধান চ্যালঞ্জ হলো এই প্রেক চু নদী পেরোনো কারণ প্রায় দু'ঘণ্টা বড় বড় বোল্ডার ও সুবিশাল ল্যান্ডস্লাইড এলাকা ক্রস করতে হয়। জংরি থেকে কোকচুরাং পেরিয়ে থাংসিং পৌঁঁছতে আমাদের আজ প্রায় ৮ ঘন্টা সময় লেগে গেল। পথে বৃষ্টি না হলেও কুয়াশায় ঢাকা, প্রায় দৃশ্যমানতাশূণ্য এই পথ যথেষ্ট ভয়ংকর ছিল। অবশেষে যখন থাংসিং পৌঁছই তখন তীব্র শীতল হাওয়া বইছে কারণ পাশেই খরস্রোতা প্রেক চু নদী। নদীর ধারে আমাদের তাঁবু খাটানোর ব্যবস্থা আজ। মাউন্ট পান্ডিম এর একেবারে পাদদেশে অবস্থান করছিলাম আমরা কিন্তু সেদিন কোনোভাবেই পান্ডিম দেখা গেল না। টানা চার দিনের ট্রেকিংয়ের ক্লান্তি শরীর আচ্ছন্ন করে তুলেছিল ফলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম সকলে। 

   

পরের দিন সকালের অপরূপ দৃশ্য দেখে মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে এসেছিল একটি কথা -"কি ভয়ংকর সুন্দর"। পান্ডিম যেন হাতের মুঠোয় ডান দিকে আর সোজাসুজি দূরে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বিরাজমান। ছুটে চলে গেলাম সূর্যোদয়ের ছবি তুলতে। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অবাক হয়ে চারপাশ পরিলক্ষণ করতে লাগলাম। আজ আমাদের কোনোরকম তাড়া ছিল না কারণ আজ আমাদের অ্যাক্লিমেটাইজেশন ডে অর্থাৎ গোচালা পৌঁছানো আর একদিনের অপেক্ষা। তাই আজ থাংসিং থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার সুন্দর সমতল উপত্যকার ২ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে লামুনেতে আমাদের ক্যাম্প। এতদিনের ট্রেক রুটে আজ প্রথম মিঠে রোদ গায়ে মেখে একটি অলস দিনযাপন এর সুযোগ পেলাম আমরা। শীতের এই দিনে এত উচ্চতায় আকাশের নীল আরো গাঢ়, আরো পরিষ্কার, আমাদের জার্নি শুরুর আবহাওয়ার ভ্রুকুটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে। 

আজ প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা এত কাছে দেখতে পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমরা আরো চনমনে এবং সতেজ মন নিয়ে রওনা দিলাম লামুনের উদ্দেশ্যে। থাংসিং থেকে লামুনের যাত্রাপথ সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন। অজস্র পাখির কলতান, না জানি কত রংবেরঙের ফুলের সমারোহে পরিপূর্ণ এই উপত্যকার পথ। বেলা একটু বাড়তেই কাঞ্চনজঙ্ঘা আবার ঢেকে গেল, এবং ক্রমশ পান্ডিমও। হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ গুলোর একেবারে যেন পায়ের নিচ দিয়ে চলেছি আমরা। বাঁদিকে প্রেক চু নদী বইছে ও নদীর অপর পাড়ে দেখা গেল একদল জংলী ইয়াক- সমগ্র পরিবার নিয়ে তারা বিচরণ করছে পর্বত রাশির নিচে বড় বড় পাথরের গুহার সামনে। লামুনে পৌঁছতে পৌঁছতে চার পাশ আবার ঘন মেঘে ঢেকে গেল। এবারে শীতল হওয়ার তীব্রতা আরো তীক্ষ্ণ ভাবে আমাদের গায়ে যেন সূঁচের মতো বিঁধতে লাগলো। একেবারে হাই অলটিটিউড মাউন্টেন বাতাসের সম্মুখীন হলাম যার প্রভাবে তাঁবু প্রায় উড়ে যাওয়ার জোগাড়। বুঝলাম একটু পরেই তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাবে। আজ লামুনে পৌঁছে লাঞ্চ সেরেই তাঁবুতে ঢুকে ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা। সন্ধ্যে হতে হেল্পার ভাইয়েরা ডিনারের জন্য ডাকতে এলো যখন, তখন ঘুম ভেঙ্গে তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে সকলে চুপ হয়ে গেলাম। আকাশ পরিষ্কার, নিকষ কালো অন্ধকারেও চাঁদ ও লক্ষাধিক তারার আলোয় চোখের সামনে উজ্জ্বল মাউন্ট পাণ্ডিম ও কাঞ্চনজঙ্ঘা, রাত পেরোলেই যাকে প্রায় ছুঁতে পারার অপেক্ষা এখন। গাইড জানালেন রাত ১.৩০টায় ফাইনাল সামিট এর জন্য বেরোতে হবে। সারারাত প্রায় তিন ঘন্টা হেঁটে ফাইনাল সামিট করব গোচা লা। গত দুদিনের ঠান্ডায় ও শারীরিক ক্লান্তিতে আমি ফাইনাল সামিট করবো না বলে বেশ কয়েকবার আমার টিমকে জানালেও তারা কেউই আমাকে ছেড়ে গোচা লা যেতে রাজি হল না। 

ভোর চারটে ত্রিশ প্রথম দেখা
কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রথম সূর্যের আলো

আকাশে তখন রঙের খেলা
                             
গোচা লা সামিট সম্পূর্ণ
অবশেষে সকলের প্রবল উৎসাহে আমি মনে জোর নিয়ে রাতে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম করে রাত ১ টায় উঠে রেডি হয়ে নিলাম গোচা লা সামিট করবো বলে। বাইরে তখন হালকা তুষারপাত হচ্ছে এবং আমাদের গাইডের দেখানো টর্চের আলো লক্ষ্য করে করে একে একে লাইন করে এগিয়ে যেতে থাকলাম আমরা। এই পথের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অক্সিজেনের অভাব। আজ মনের উত্তেজনা সবথেকে বেশি, সেই কোন সুদূর দক্ষিণবঙ্গ থেকে এত পথ পেরিয়ে, এত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে এসেছি শুধুমাত্র আজকের এই রাতে এই পথ পেরোবো বলে- স্বভাবতই আনন্দ, উত্তেজনা, সংশয়, সাবধানতা সবকিছুকে অবলম্বন করে শরীর ও মনের সবটুকু দিয়ে হেঁটে চলেছিলাম আমরা; পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সূর্যের প্রথম কিরণ প্রত্যক্ষ করব বলে। প্রায় দেড় ঘন্টা চলার পর পাশে বহমান জলের শব্দে বুঝতে পারলাম এসে পড়েছি গ্লেশিয়াল লেক- সমিতি লেকের সামনে।  ফেরার পথেই এই রূপসী হ্রদের নীলচে সবুজ কাঁচের মত স্বচ্ছ জলরাশি ও জলে সামনের তুষারাবৃত পর্বতের প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করেছিলাম। এবার গাইড বললেন এখান থেকে শুরু হচ্ছে তীব্র চড়াইয়ের পথ। 


খুব সাবধানে এক পা, দু পা করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে উঠতে থাকলাম। যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, একটিও তারা ছিল না আকাশে। কিন্তু এবার আকাশের একপাশে তারা ফুটতে দেখা গেল। সময় ভোর ৪টে- সামনে তাকাতেই সাদা সাদা বরফের পাহাড়ের ছায়া চোখের সামনে ভেসে উঠলো, মনে হল দৌড়ে চলে যাই। কিন্তু অক্সিজেনের ঘাটতি আমাদের গতি স্লথ করে তুললো। ধীরে ধীরে বড় বড় বোল্ডার অন্ধকারের মধ্যে পার করে গোচালা সামিট করলাম যখন, ঘড়িতে ভোর ৫:১৫। ১৬ হাজার ফিট উচ্চতায় উঠে ঠান্ডার তীব্রতায়, মনের তৃপ্তিতে আর স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় এসে বড় এক পাথরের উপর বসে পড়ে সামনের অদ্ভুত ভূমিরূপ, সারা জীবন ভূগোলে পড়া হিমবাহের ক্ষয় কার্যের ফলে সৃষ্ট সমস্ত ভূমিরূপ এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ পান্ডিম, তিনচেংখাং, কাব্রু, কোকথাং, রাথং সহ অন্যান্য সু উচ্চ পর্বত শৃঙ্গগুলি মন ভরে দেখতে থাকলাম। সামনে তখনও মেঘ পুরোপুরি কাটেনি তবে মনের সংশয় ঘুচে গিয়ে কিছুক্ষণ পর উল্টোদিকের পাহাড় থেকে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ল সবচেয়ে উঁচু কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায়। ধীরে ধীরে পাশে সবকটা পর্বত শৃঙ্গ আলোকিত হয়ে উঠলো,চোখের সামনে আগুন রঙের হোলি খেলা চললো আর আমাদের চোখে তখন একরাশ মুগ্ধতা। স্তব্ধ, নির্বাক আমরা সকলে মিলে কমপ্লিট করলাম গোচা লা সামিট। 
এরপর আবার একই রকম পথ দিয়ে তিন দিন ধরে ট্রেক করে নেমে এলাম ইউকসমে। জীবনের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য মনের অদম্য জেদ, ইচ্ছাশক্তি এবং সাহসই যে আসল এই ৮ দিনব্যাপী যথেষ্ট কঠিন ট্রেক আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে গেল। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সকলেই বেশ কিছুদিনের শারীরিক পরিশ্রম, যথাযথ হোমওয়ার্ক, এবং ট্রেক রুটের কিছু ছোট ছোট সাবধানতা অবলম্বন করলেই এই ট্রেক সম্পূর্ণ করা সম্ভব। তবে নিজের শরীরের ক্ষমতা বুঝে তবেই যে কোন পাহাড়ি পথ অতিক্রম করা উচিত। কারণ প্রত্যেকের নিজস্ব শারীরিক ক্ষমতা পৃথক এবং সেটা তার নিজস্বই হয়।



*ছাত্রী, ২০১০




মন্তব্যসমূহ

  1. এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলবার মতো উপভোগ্য লেখা। সঙ্গের ফটো ও খুব সুন্দর।
    অনেক শুভকামনা রইল ভবিষ্যৎ ট্রেক এর জন্য।

    উত্তরমুছুন
  2. এমন কঠিন পথের অনাবিল সৌন্দর্যে মন প্রাণ ভরে গেল। অসামান্য সব ছবি আর এত সুন্দর বর্ণনায় মুগ্ধ হলাম।
    আগামীর জন্য শুভকামনা রইলো।
    (কস্তুরী )

    উত্তরমুছুন
  3. মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়লাম। আমি নিজেও একবার গেছিলাম, আপনার লেখাটা পড়ে সেই সমস্ত স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আগাম ট্রেকের জন্ন্যে অনেক শুভেচ্ছা রইল

    উত্তরমুছুন
  4. আপনার লেখনী ও উপস্থাপনার ভাষা অতি সুন্দর..., বিশেষ করে পথের বিবরণ.
    পরিশেষে আপনার প্রতিটা ছবিতে আলোর ব্যবহার অসাধারন |

    উত্তরমুছুন
  5. খুব ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অপেক্ষা

প্রথমা