প্রথমা

প্রেয়সী মুখার্জী







এই জন্মে আমি এক সাধারন কন্যা, কিন্তু বিগত বহু জন্মেই আমি নানা রূপে আবির্ভূত হয়েছি এই ধরাধামে। আজও আমার পূর্বজন্মের উপস্থিতির সন্ধান আমি পাই গাছের পাতায়, নদীর জলে কিংবা সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে। হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে আমিই অবিনশ্বর, আমিই সত্য। তাই তো কবিগুরু লিখেছিলেন, "সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।"

মানুষই সত্য আর আমি মানুষ। মেয়েমানুষ বা মেয়েছেলে নই সম্পূর্ণ একজন মানুষ। আমিই সেই মানুষ যে প্রাক বৈদিক যুগে 'অপলা' নামে বিরাজিত ছিলাম, আবার পরবর্তী বৈদিক যুগে আমিই সেই 'গার্গী' আমিই ছিলাম কালিদাসের 'শকুন্তলা'আবার আমিই সত্যবানের প্রাণ রক্ষাকারী 'সাবিত্রী'। আমি আজও বৈকুণ্ঠ নিবাসী শ্রীনারায়নের সহধর্মিনী 'দেবী লক্ষী'আবার আমার হরণের অপরাধে ত্রেতা যুগে ধ্বংস হয়েছিল সোনার লঙ্কা। আমিই সেই অভাগিনী নারী, 'রাধা' যেকিনা তার প্রাণাধিক প্রিয় কৃষ্ণকে কখনই নিজের করে পাই নি। আমিই পরমা প্রকৃতি আবার আমি দুর্গতিনাশিনী  'দেবীদুর্গা'।

হ্যাঁ, আমিই সেই নারী যে কিনা 'রাজিয়া সুলতানা' নামে মধ্যযুগের কাল অন্ধকারেও নিজের দাপট বজায় রেখেছিল। 'লক্ষীবাঈ' নামে লড়েছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে। 'দেবী চৌধুরানী' রূপে হয়ে উঠেছিল ধনীদের ত্রাস আর দরিদ্রের মা। 

 ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ডাক্তার 'কাদম্বিনী বসু'আমিই ছিলাম সে। বাবা ছিলেন আমার নিতান্তই উদার এবং ব্রাহ্মসমাজের সদস্য। না হলে কি সে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় দাদা মনমোহন বসুর বাড়িতে পাঠাতেন আমায় শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে? প্রথমে কেশবচন্দ্র সেন মহাশয় যদিও আমায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করতে চান নি, তবে আমার জেদ তাকে পিছু হটাই 

আমিই ছিলাম মাস্টারদার প্রিয় ছাত্রী 'প্রীতিলতা'। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই আমিই করেছিলাম। তমলুকে মিছিলে সবার আগে থেকে লড়াই করে শহীদ হওয়া 'মাতঙ্গিনী' সেইও আমি।

আমিই আজকের যুগের সেই আধুনিকা নারী যে একই সাথেই সামলাচ্ছে তার নিজের ঘর বাড়ি এমনকি অফিসে বসের তাড়া।

আবার আমিই সেই নারী যার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল পৃথিবীর সকল আলো। জন্মগ্রহণের আগেই মেরে ফেলা হয়েছিল। কন্যা সন্তান লাভবান না হওয়ায় আমার মায়ের জায়গা হয়েছিল রাস্তায়। আমার হাত পা মুখ সব বন্ধ করা হয়েছিল কুসংস্কারের বেড়াজালে। তাই তো আমি বহুবার সতী হয়ে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছি, বিধবা হয়ে ছোট বয়স থেকে পালন করেছি একাদশী, হয়েছি কাশিবাসী। দেবদাসী হয়ে নিজের শরীর কে দান করেছি মন্দিরের পুরোহিতের হাতে। প্রাণ যায় যাক তবে মান দেবো না এই পনে বিনা চিকৎসায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি বহুবার।

হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমিই সেই নারী, যাকে কিনা আজও প্রতিনিয়ত শিকার হতে হয় যৌন হেনস্থা কিংবা গার্হস্থ্য সহিংসতা এর মতো ঘটনার। আজও দুচোখ দিয়ে খুঁজলেই দেখতে পাবে আমায়। তাকাও না একবার মণিপুরের দিকে, কিংবা দিল্লিতে দেখো একবার আর জি করে কিংবা কামদুনিতে। একবার তাকাও নিজের পাশের বাড়িতে কিংবা নিজের ঘরেতে ঠিক খুঁজে পাবে আমায়। প্রথমা রূপে আমি আজও বিরাজমান সবার মধ্যে।

*ছাত্রী ,২০২৪

মন্তব্যসমূহ

  1. পড়তে পড়তে অজান্তেই চোখটা ভিজে গেলো, সত্যি ই তো....খুব ভালো লাগলো পড়ে

    উত্তরমুছুন
  2. বাঃ বেশ পাকা হাতের লেখা তো .....

    উত্তরমুছুন
  3. খুব সুন্দর.... দারুন একটা লেখা

    উত্তরমুছুন
  4. খুব সুন্দর একটি লেখা

    উত্তরমুছুন
  5. খুব সুন্দর লেখা। চমৎকার। 🤗🤗

    উত্তরমুছুন
  6. Sudeshna Sanyal: Well written thought provoking article!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অপেক্ষা

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা