অপেক্ষা


 




শরণ্যা সরকার

অটোস্ট্যান্ডে নেমে হাতঘড়িটা দেখল পারমিতা। রাত নটা বাজতে পাঁচ মিনিট। এত রাতে অটো পাবে কিনা ভেবে মনে কিঞ্চিৎ ভয় জাগল। গরমে তাঁতের শাড়িটা গায়ে বিঁধছে। আঁচল দিয়ে গলায় হালকা বুলিয়ে নিয়ে দ্রুতপায়ে স্ট্যান্ডে এগিয়ে দেখল, একটা অটো দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত আজকের শেষ অটো। তড়িঘড়ি কাছে গিয়ে দেখে, সে-ই প্রথম যাত্রী, অর্থাৎ এখনও তিনজনের জন্য তাকে অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। নিজের উপরই ভীষণ রাগ হল, কেনো একটু আগে বেরোতে পারেনি সে কাজ সেরে! এতক্ষণে হয়তো ঘরে পৌঁছেও যেত। গাড়ি বুক করবে ফোনে? ২০ টাকার রাস্তা শুধু শুধু ২৫০ টাকায় যাওয়া একটু বাড়াবাড়ি না?
সামনে অটো চালক এসে বসতে বলে উধাও হয়ে গেলো। দূরে অস্পষ্ট অন্ধকারে কয়েকজন বসে আছে, ওদের মধ্যেও হয়তো কেউ যাবে? সাতপাঁচ ভেবে উঠে বসল সে পেছনের সিটে। ভ্যাপসা গরমে কোলের উপর বড়ো হাতের ব্যাগটা রেখে ফোনে চোখ রাখল পারমিতা। কোনো মিসড কল নেই। সকাল থেকে শিউলি একবারও ফোন করেনি। ফোন খুলেই শিউলির মিসড কল দেখলেও একটু শান্তি আসে পারমিতার মনে। বিগত ৩ বছর ধরে শিউলি তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে, যখনই সুযোগ হয় মাকে নিজের দিনপঞ্জিকা না শোনালেই নয় তার। কেনো ফোন করেনি এখনও? এত ব্যস্ততা তার? অভিমান হলো একটু পারমিতার। হঠাৎ একটা ঠান্ডা স্রোত ছড়িয়ে গেল বুকে, শিউলি ঠিক আছে? এরকম চিন্তা করলে সে অবশ্য বেদম চোটে যায় মায়ের উপর। পারমিতার খুব অসহায় মনে হয় মাঝে মাঝে, তার দুশ্চিন্তার কারণ কেনো বোঝেনা কেউ? একমাত্র পাখি বাসায় নেই তার কষ্ট, আবার তার উপর জমা অভিমান মনে ঘনিয়ে আসে। বোতাম টিপে কানে চেপে ধরল ফোন, কেউ ধরল না।
ফোন নামিয়ে রেখে ব্যাগটা একটু বুকের কাছে টেনে শক্ত করে ধরল পারমিতা, হাত ঘড়িতে সওয়া নটা, পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে, মানুষ যাচ্ছে, সময়ও চলে যাচ্ছে, এখন তার ব্যাগ ই তার সম্বল, তাই সেটাই আঁকড়ে বসে থাকা।
অটো থেকে মুখ বাড়িয়ে পারমিতা দেখল ভিড় রাস্তা কাটিয়ে দুজন এগিয়ে আসছে তার দিকে। দুজন না বলে দেড়জন বললে ভালো হয়, একটি বছর ৩০-এর মহিলা, কোলে একটি আড়াই-তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে। পারমিতাকে দেখে একটা অসহায় হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, "কাঁঠালবাগান যাবে তো এটা?" উত্তরে হ্যাঁ শোনাতে অটোতে উঠে বসল। যাত্রী এসেছে দেখে অটো চালক এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন অন্ধকার থেকে উঠে এলো বাকি দুজন সহযাত্রী, দুজন বৃদ্ধ। পারমিতার ধরে প্রাণ এলো, যাক এবার তাহলে বাড়ি পৌঁছাতে পারবে সে। তিন প্রৌঢ় প্রৌঢ়া কে দেখে মেয়েটি কোল থেকে বাচ্চাটিকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল, "একে একটু নিয়ে বসুন আমি সামনে বসে যাচ্ছি।" ব্যাগ সামলে পারমিতা কিছু করে ওঠার আগেই তার পাশের যাত্রী বাড়িয়ে দিল দুটো শীর্ণ হাত। কোলে বসিয়ে নিল টেনে। বাচ্চাটি উঠে বসে এক হাত দিয়ে পারমিতার হাতের দুটো আঙুল চেপে ধরল। সবাই কিছু না কিছু ধরে বসে আছে, ওরই বা কি দোষ।
বাচ্চাদের দেখতে পারমিতার খুব মজা লাগে, বারবার তার শিউলির কথা মনে পড়ে। ছোটো ছোটো হাতগুলো, শিউলির ছোটবেলায় অটোয় ওঠা মানে ছিল তার কোলে চেপে বসা, সিংহাসন তার, আর কিছুর ভয় নেই ওখানে বসলে। মনে পড়ে গেলো শিউলির সাথে আজ তার কথা হয়নি, চিন্তা হল অল্প। ওর ওখানে কত বন্ধু, কত কথা বলার লোক, সে সারাক্ষন ব্যাস্ত কিছু না কিছু নিয়ে। পারমিতারও তাই, কাজের সূত্রে দিনে অনেক লোকজনের সাথে ওঠা-বসা করতে হয়, কিন্তু দিনের শেষে কোথাও যেনো সে বড্ড একা, তার জগত কয়জনকে ঘিরে। তাদেরকেই আঁকড়ে বাঁচতে চায় সে। পুজো প্রায় এসেই গেছে, এবার ছুটির অভাবে শিউলি আসতে পারবেনা বলেছে। পারমিতা ভেবেছিল মেয়েকে বোঝাবে, কিন্তু শেষমেশ কিছু আর বলেনি। কাটবে নাহয় একটা পুজো, শিউলি ছাড়া।
অটো ছুটছে ঝলমলে জনবহুল রাস্তা ধরে, পারমিতার মুখে, চুলে হালকা ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে। একহাতে ব্যাগ ধরে, অন্য হাতে একটা ছোট্ট হাত। রাস্তার ধারে জায়গায় জায়গায় প্রতিবাদ মঞ্চ বানানো, ভিড় করে আছে লোকজন, মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে, হাওয়া মানুষের ক্ষোভে গরম, সবরকম আওয়াজ মিলে যেনো মানুষের হাহাকারে পরিণত হয়েছে, বাতাসে সেই হাহাকার ছড়িয়ে যাচ্ছে। কান পর্যন্ত পৌঁছানোর কাতর আর্জি সবার। রাস্তায় নানা জায়েগায় জমায়েতের জন্যে অটোকে থেমে থেমে চালাতে হচ্ছিলো, অটোচালক মুখে আওয়াজ করে বিরক্তি প্রকাশ করে উঠলো, ‘এই এক হয়েছে’।
বাচ্চাটা অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করে যাচ্ছে পাশে। পারমিতার হাত মাঝে মাঝে চেপে ধরে। সামনে থেকে মা মাঝে মাঝে পেছন ফিরে "শান্ত হয়ে বসো" বলেও কোনো লাভ হয়নি। বাকি দুজন নির্বিকার। অটো রাস্তায় জ্যামে দাড়িয়ে, পাশের ঝলমলে গয়েনার দোকান থেকে আসা চড়া আলোয়ে অন্ধকার অটোর মধ্যে এসে পরছে। পারমিতা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে দেখল বাচ্চাটিকে। এতক্ষণ শুধু সাদা ঘের দেওয়া ফ্রকটা চোখে পড়ছিল। সেই সাদা ফ্রকের উপর দিয়ে এমন চেপে ধরে আছে কেনো লোকটি! কোলের মধ্যে কেমন টেনে বসে আছে! হাতগুলো ছাড়িয়ে বাচ্চাটি যেন মায়ের কাছে যেতে চাইছে। মুখের দিকে চোখ যেতে পারমিতার আর বোঝার বাকি রইল না কিছু।
তখন শিউলি ৭ বছরের, মা-বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়া, ভিড় বাসে ফাঁকা জায়গা পেয়ে তাড়াতাড়ি মা নিশ্চিন্তে বসিয়ে দিয়েছে, পাশে একজন বৃদ্ধ। বসার জায়গা পাওয়া সত্ত্বেও সমানে মা-কে ডেকে যাওয়ার জন্য একটা সময়ে বিরক্ত হয়ে পারমিতা বলে উঠল, "বসার পরও আমায় ডেকে ডেকে জ্বালিয়ে মারবে মেয়েটা।" সেদিন রাতে শিউলি মায়ের সাথে কথা বলেনি। পারমিতাও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি হয়তো কোনোদিন।
কোল থেকে ব্যাগটা নামিয়ে, পারমিতা বাচ্চাটিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
-"আমার কাছে এসো।"
লোকটি মৃদু প্রতিবাদ করার আগেই পারমিতা ঝাঁঝিয়ে উঠলো
-"ওকে আমার কোলে দিন, আমি ওর মাসি হই,"
একরকম তুলে টেনে নিল নিজের কোলে।
রাগে কান গরম, দপদপ করছে মাথা।
সামনে থেকে ঘুরে অবাক চোখে তাকিয়ে মেয়েটির মা, চোখ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করল পারমিতা। কিছুটা গিয়ে লোকটি নেমে যাওয়ায় কোলে টানটান হয়ে বসে থাকতে থাকতে বাচ্চাটি হঠাৎ পিছিয়ে গিয়ে হেলান দিয়ে বসল পারমিতার বুকে। যেনো খুব একটা মূল্যবান জিনিস কোলে বসে, মনে হল পারমিতার, এমন একটি জিনিস, যে অল্প স্পর্শে বুঝতে পারে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সেই মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ফুলের মতো।
বাকি রাস্তা কাটল পারমিতার সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে। ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে আছাড় খাচ্ছে, ভালো লাগছেনা কিছু। শরীরগুলো যেনো একেকটা ক্যানভাস, বয়ে নিয়ে চলেছে নানারকম আঁচড়, ছোঁয়া, বয়সের কোনো গাছপাথর নেই, সারা জীবনের জন্য সেইসব স্মৃতিও সঙ্গী। যেভাবে প্রদীপকে হাত দিয়ে আগলে রাখতে হয়, সেভাবে একে অপরকে আগলাতে ইচ্ছা করে, যাতে সেই এক জিনিস আবার না ঘটে। অটোর বাইরে থেকে প্রতিবাদ মিছিলের আওয়াজটা যেনো আরো জোরালো হয়ে আসছিল কানে, বুকের মধ্যে দামামা পেটাচ্ছে কেউ।
স্টপেজে পৌঁছাতে ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্চাটা, মায়ের কাছে দিয়ে পারমিতা ধীর পায়ে এগোতে লাগল তার সাথে।
-"নাম কি মেয়ের?"
-"মহাশ্বেতা"
-"খুব সুন্দর নাম, মা সরস্বতী "
-"আজ অটোয়—"
-"কিছু না, কার কি উদ্দেশ্য থাকে বোঝা তো যায় না, তাই সাবধান থাকা, আর কি।"
-“আমার সত্যিই উচিত হয়নি, আমি বুঝতেই পারিনি”
পিঠে আলতো হাত রাখল পারমিতা।
সময় হচ্ছে দশটা আট, কাঁধ থেকে ব্যাগটা সোফায় নামিয়ে রেখে পারমিতা ফোনে চোখ রাখল, শিউলির ৪টে মিসড কল। মেসেজ করেছে,
-"কোথায় তুমি, অনেকবার কল করলাম।"
-"অটোয় ছিলাম,


এক বাচ্চা হাত ধরে ছিল, ঠিক তোমার মতো, তুমিও ছোটবেলায় অটোতে উঠলে ওরম করতে। "


*ছাত্রী ,২০২৪

মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো লিখেছিস। এই ভাবেই অনেক সময় আমাদের ছোটবেলা গুলো ভয়ে, আতঙ্কের কালো ছায়াই ঢেকে যায়। এই রকম একটা সত্য ঘটনা গল্পের আকারে তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব সুন্দর লিখেছো ♡

    উত্তরমুছুন
  3. বেশ সুন্দর লেখা

    উত্তরমুছুন
  4. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  5. লেখনী টি বেশ সুন্দর লাগলো

    উত্তরমুছুন
  6. খুব সুন্দর লেখাটা হয়েছে দিদি। 🤗💝

    উত্তরমুছুন
  7. খুব ভালো লাগলো লেখা টা পড়ে♥️

    উত্তরমুছুন
  8. Sudeshna Sanyal - খুব ভাল লাগল। তুমি খুব প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় একটা বিষয়ের উপর খুব সুন্দর লিখেছ।

    উত্তরমুছুন
  9. মন ছুঁয়ে গেল। সুন্দর লেখনী।

    উত্তরমুছুন
  10. Beautifully expressed the emotions of literally every woman. Just amazing!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রথমা

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা