সবুজ মেখলিগঞ্জ ও আন্তর্জাতিক সীমানা
মৌসুমী ব্যানার্জী
রাত ১০.০৫ এ ট্রেন সময় মতোই ছাড়ল। দার্জিলিং মেল। ট্রেনে উঠে জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিজের বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। ছোটবেলা থেকেই রাতের ট্রেনে এই কাজটি আমার বেশ লাগে। আমাদের গন্তব্য শেষ স্টেশন, হলদিবাড়ী।
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল। ট্রেন তখন কিষেণগঞ্জ ছাড়ছে। জুলাই মাসের শেষের দিক। জানলার বাইরে সবুজ আর সবুজ। দিগন্তে মেঘলা আকাশে এই সবুজ মিশে গিয়েছে। আকাশে মেঘের স্তর– নানা রঙের বাহার এক এক স্তরে। এরই মধ্যে নতুন দিনের শুরুর আভাস। নরম কমলা রঙ প্রকৃতির অঙ্গ জুড়ে। ক্ষেতের জমা জলে ছড়িয়ে পড়েছে নরম কমলা রঙ। মেঘের ফাঁক দিয়ে সূয্যিমামা দেখা দিলেন। কি অপরূপ রূপে তখন প্রকৃতি! জানলার কাঁচের ভিতর থেকেই ছবি নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
আমার গন্তব্য মেখলিগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। আরও অনেকের মতোই এই শাখার অধ্যক্ষ মহারাজের কাছ থেকে ডাক পেয়েছিলাম সেই অতিমারীর শেষের সময়কালে। সবুজ খোলামেলা প্রকৃতি, তিস্তা নদী, আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখাও পাওয়া যায় – জেনে অবধি মন চেয়েছিল যেতে। এইবার আশ্রমের অতিথি নিবাসে দিন কয়েক থাকবার সৌভাগ্যও জুটে গেল। তারপরেই এই ট্রেন যাত্রা।
ছোট ছোট কত স্টেশন চলে যাচ্ছে। থেকে থেকে পাহাড়ও দেখা যাচ্ছে। সময় মতোই হলদিবাড়ী স্টেশনে ট্রেন পৌঁছল। ঝকঝকে প্ল্যাটফর্ম। এই লাইনে ভারতবর্ষের শেষ স্টেশন এটি। আমাদের কামরা দাঁড়িয়েছে প্ল্যাটফর্ম শেডের বাইরে। হালকা রোদ্দুর, সঙ্গে বড় বড় গাছপালা ঘেরা প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মে কয়েকজন টোটো চালক এসে পৌঁছেছেন। ১৪ কি মি দূরে মেখলিগঞ্জ আশ্রম যাব শুনে একজন এগিয়ে এল। সে আশ্রমের পরিচিত। ভাড়া ঠিক করেই সে আমাদের দুখানা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে এগোল। তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমার তো চোখ কপালে ওঠার দশা হয়ে গেল। স্টেশনের বাইরে যাওয়ার পথে কাজ চলছে বলে বালি, ইঁট ইত্যাদি রাখা আছে। তাছাড়া, জানা গেল সেই পথটি বেশ দূরে আর 'বড়দি' মানে আমার পক্ষে তা পার করা নাকি কষ্টকর হবে। তাই খুব সহজ কাজ হল প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝপাং লাফ দেবে বড়দি ট্রেন লাইনের উপর, তারপর রেললাইন পার করেই ঐ যে গাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী টুকটুকি – ব্যস্, ওতে বসে গেলেই হল। আর এখন তো কোনও ট্রেন আর নেই, সুতরাং রেললাইনও নিরাপদ। এমন সহজ কাজের কথা শুনে আমি কেমন কাঁদ কাঁদ হয়ে গেলাম। আমার স্বামীও তাকে বোঝানর চেষ্টা করলেন । এরই মধ্যে কয়েকজন যাত্রীকে দেখলামও অমন ভাবেই পার হয়ে যেতে। দু একজন মহিলা আমাকে সাহসও দিয়ে গেলেন। আমার স্বামী তো দিব্যি টুকুস লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন। আমার সদ্যপ্রাপ্ত ভাইটি কোথা থেকে এক কাঠের বাক্স নিয়ে এসেছে বড়দির পা রাখার জন্য। সে বাক্স দেখে আরোও ঘাবড়ে গেলাম। অতি যত্নে স্নেহে লালিত দেহটির ভার তো মন্দ নয়। প্ল্যাটফর্মে পা ঝুলিয়ে বসেও বাক্সর নাগাল আমার পা পেল না। ঠিক হল ভাইটি আমার বাক্স কাম সিঁড়ি সামলাবে আর আমাকে আমার স্বামী। আমি শুধু ছোট্ট লাফ দেব। যাই হোক, সমবেত প্রচেষ্টায় আমি নিরাপদে রেললাইনে অবতরণ করলাম।
এরপর শুরু হল টোটো সফর। কালো পিচের রাস্তার দুধারে ছোট ছোট দোকান, টিন বা খড়ের চালের বাড়ি আর সবুজ ফসলের ক্ষেত। মাঝেমধ্যে পাকা বাড়ি, দোতলা বাড়িও। শুদ্ধ, দূষণমুক্ত খোলা হাওয়া মুখে চোখে লাগছে। হালকা রোদ, পাটের ক্ষেতে কোথাও পাট জলে ডোবানো, ভিজে পাটের কটু গন্ধ , কোথাও বা বাঁশের উপর পাট শুকানো হচ্ছে – সবই ভালো লাগছে। ভাইটি থেকে থেকেই কত রকম কথা বলছে। টোটো তে লাগানো রয়েছে এফ এম রেডিও। সেখানে চলছে "তোমায় হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না। " –
পথে এল তিস্তা নদীর উপর নব নির্মিত "জয়ী সেতু"। বছর তিন হল এই ৩.৮ কি মি লম্বা সেতুটির। আগে হলদিবাড়ী স্টেশন থেকে মেখলিগঞ্জ যেতে ৭০ কি মি পার হতে হত। এই সেতু এখানকার মানুষজনের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে আগে মেখলিগঞ্জ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকত। তিস্তার সুবিশাল রূপ দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
আশ্রমে পৌঁছে স্নান, খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে অধ্যক্ষ মহারাজের পরামর্শে একটু আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে এলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা এমন সময়ে দেখতে পাওয়া যায় না। দেখাও গেল না। সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের আরাত্রিকে যোগ দিলাম। মন্দিরে উপস্থিত স্থানীয় কিছু মানুষ জনের সঙ্গে টুকটাক আলাপচারিতাও হল।
আগামীকাল গুরু পূর্ণিমার উৎসব। অতিথি নিবাসের ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাতের কালো আকাশে জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। জানলা দিয়ে আসা নরম রূপালী জ্যোৎস্নায় ঘর ভরে গেল। ঘরের বাইরে অবিরাম ঝিঁঝিঁর ডাক – ঝিম ধরানো । ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন গুরু পূর্ণিমা। সকাল থেকেই মন্দির চত্বর উৎসবে মুখর। বাহুল্য বর্জিত আয়োজন। স্থানীয় ভক্তদের ভীড়ে মন্দির গৃহ পরিপূর্ণ। শিলিগুড়ি থেকেও ভক্তরা এলেন বেলার দিকে। দুপুর পার হয়ে গেল উৎসবে। খুব চড়া রোদ। বিকেলে রোদ পড়লে স্থানীয় বাজারে ঘুরে এলাম।
পরের দিন বেলায় একটি টোটো ভাড়া করে গেলাম "তিন বিঘা করিডোর"। ঐতিহাসিক দেশভাগের ফলস্বরূপ এক টুকরো বাংলাদেশের অংশ – দহগ্রাম থেকে যায় ভারতবর্ষের মধ্যেই। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ভারতবর্ষের তিন বিঘা জমি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। মেখলিগঞ্জ থেকে ৯ কি মি দূর " তিন বিঘা করিডোর "।
কিছু পরে শুরু হল রাস্তার ধারে চা বাগান আর উঁচু কাঁটাতারের বিভাজন। চা বাগানের মাঝখান দিয়েই চলেছে কাঁটাতার। কখনও বাঁদিকে, কখনও বা ডানদিকে সুবিশাল কোনও ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে। বিভাজনের দুই দিকেই অনেকেই ক্ষেতে কাজ করছেন, গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও বা কাঁটাতার নেই , সেখানে ক্ষেতের মাঝখানে চওড়া, উঁচু, সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো স্তম্ভ – সেটিই নাকি সীমানা নির্দেশ করছে, টোটো দাদা জানালেন ।অবাক হয়ে দেখছিলাম। বি এস এফ অফিস এসে গেল। ভারতবর্ষের রাস্তার দুই ধারে বি এস এফ অফিস। প্রহরারত কর্মীরা আমাদের সামান্য পরিচয় জানতে চাইলেন। তারপর হৈ হৈ করেই বললেন ভালোভাবে ঘুরে দেখতে। চত্বরটি ঘুরে ভালো করে দেখলাম। ঐ রাস্তা দিয়েই যাত্রী নিয়ে চলে গেল বাংলাদেশের টোটো। সবুজ রঙ তার। নম্বর প্লেট বাংলায় লেখা। বাংলাদেশী বাইক আরোহীদেরও দেখা গেল। একশো মিটার দূরত্বে ওপার বাংলা – অন্য দেশ।

.jpeg)

মাইলফলকে লেখা আছে 'পাটগ্রাম' নামটি। ওদিকে ওদেশের সীমান্ত রক্ষীরা প্রহরায় রত। ঘন গাছপালা এখানেও। কত রকমের পাখিরা দলে দলে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাচ্ছে। এদিকের গাছ থেকে কয়েকটি শালিক ওপারের গাছে গিয়ে বসল। একটি কুকুর শুয়ে আছে। ভারতবর্ষের সীমানায়। বি এস এফ কর্মীদের সঙ্গী সে। পাখিদের মতো সে ও হয়তো নির্বিবাদে এদেশ থেকে ওদেশে যাওয়া আসা করে। ফেরার পথ ধরলাম।
বিকেলে রোদ পড়লে আশ্রম থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। টোটো স্ট্যান্ডে গিয়ে টোটো চালকদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম এদিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও আছে সীমানা। যাবেন নাকি?– টোটো চালকের এই প্রশ্ন শুনে উত্তরে সরাসরি টোটোতে বসেই পড়লাম। একটু পরেই পাকা রাস্তা ছেড়ে আমাদের নিয়ে সরু, মেঠো পথে টোটো এগিয়ে চলল। ঘন জঙ্গল সেই পথে। আকাশ প্রায় দেখাই যায় না। দু পাশেই মাটির বাড়ি। একইরকম – একটি উঠোনকে ঘিরে আলাদা আলাদা কয়েকটি কাঁচা বাড়ি। উঠোনে ছোট্ট মন্দির। ঘরের পাশেই জমিতে পানের চাষ হয়েছে। বাঁশের জঙ্গল ঘেরা আর ফলের গাছও। বেশ শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া এমন ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশে। এখানেও লোকজন বিশেষ দেখা গেল না। এরপর সোজা গিয়ে একটু চওড়া রাস্তায় পৌঁছেই দেখা গেল আবার কাঁটাতারের বিভাজন। তারপরেই সারিবদ্ধ চা গাছ। চা গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সর্পিলাকারে বয়ে যাচ্ছে একটি নদী। নদীর ওপারে চা গাছ – বাংলাদেশের। ওদিকেও আছে বিভাজন। এদিকে দূরে উঁচুতে বি এস এফ এর ওয়াচ টাওয়ার। টোটো চালককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল চা চাষী, মজুরদের বি এস এফ দফতরে সচিত্র পরিচয়পত্র জমা করে তবেই তারা নদীর এই পারের বাগানে যাওয়ার অনুমতি পান।
আমরা এগিয়ে চললাম কাঁটাতারের পাশ দিয়ে। হঠাৎ পথ আটকে দিলেন বি এস এফ আধিকারিক। আমাদের পরিচয়, কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, কোথায় থাকছি জানতে চাইলেন। ভাগ্যিস সঙ্গে পরিচয় পত্র ছিল। অসুবিধা হল না সেইজন্য। অফিসারটি অত্যন্ত ভদ্রভাবে বললেন, "এই পথ সাধারণের জন্য নয়। আপনারা ফিরে যান।" টোটো চালককে একটু বকা দিয়ে ফেরবার রাস্তা বলে দিলেন। আমরা না জেনে গিয়েছিলাম। কিছুটা লজ্জাবোধ হল।
বি এস এফ অফিসারের বলে দেওয়া ফেরবার রাস্তাটি বেশ ভালো লাগল। সর্পিলাকার নদী, সানিয়াজান বা আঞ্চলিক ভাষায় সেনিয়াজান– মেখলিগঞ্জের এই ছোট নদীটির ধার দিয়ে নদীর সঙ্গে এঁকেবেঁকে চলেছে চায়ের বাগানও , ধান গাছ । বড় সুন্দর ছবি । নদীটি এরপর চলে গিয়েছে বাংলাদেশে। এই অঞ্চলটি রাজবংশী সম্প্রদায় অধ্যুষিত। দেশভাগের আগে অনেকগুলি মুসলিম পরিবার ছিল। তাঁদের বেশীরভাগই এখন বাংলাদেশে। টোটো চালক দাদা বললেন সানিয়া বা সেনিয়া কথাটি রাজবংশীদের আঞ্চলিক ভাষায় 'পাটের একটি অংশ, যা ভিজিয়ে ঘর লেপনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে আর 'জান' ছোট নদীকে বলা হয়। মাত্র কয়েক বছর আগেই এই নদীর মাধ্যমে গরু পাচার হত। টোটো দাদা নিজেও লিপ্ত ছিলেন এই কাজে, নিজেই জানালেন। তবে এখন তা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ। কাজটি ভালো নয় বলে বুঝেছেন। এই রাস্তার ধারের কিছু বাড়িতে দেখা গেল মাটির ঘরের দাওয়া ছাড়িয়েই ছোট্ট চায়ের বাগান। অদ্ভুত লাগল দেখে। সানিয়াজান নদীটিতে সারাবছর তেমন জল থাকে না। শুকনো সময় বোরো ধান চাষ করা হয়ে থাকে নদীর চরে।
পরের দিন বিকেলে গেলাম 'জয়ী সেতু' তে। সূর্যাস্তের রঙের খেলা দেখতে। সেতুর ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তিস্তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এপার ওপার প্রায় দেখা যায় না, এতটাই চওড়া তিস্তা এখানে। নদীর বুকে ছোট ছোট ঢেউ। সোনালী রোদে চিকচিক করছে। অনেকগুলি নৌকা। যাত্রীবাহী, মালবাহী। ছবির মতো। নৌকা গুলি বাঁধা আছে সেতুর অন্য পাশে। আর ঐ দূরে যেখানে সবুজ গাছগুলো আভাসে শুধু বোঝা যায়– এই তিস্তারই বুকে যেখানে নৌকোগুলিকে শুধুমাত্র ছোট বড় বিন্দু বলে মনে হয় – সেটি বাংলাদেশ। তিস্তা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গিয়েছে ঐ পথ ধরে।
এদিকে নদীর চরে মাছ ধরবার মাচা বেশ অনেকগুলি। বাঁশের মাচা করে নৌকার ছই এর মতো একটি অংশে একজন বসে বিশাল জাল ছড়িয়ে মাছ ধরছেন। অনেকগুলি বক ঘুরে বেড়াচ্ছে কাদায়। কয়েকটি মাছরাঙা নদীর বুকে এসে ছোঁ মেরে মাছ ধরে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের আভা ওদের উজ্জ্বল নীল, খয়েরি, সাদা, কালো , লাল রঙের সঙ্গে মিলেমিশে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। ছপছপ করে নৌকার দাঁড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। সূর্যাস্ত হয়ে গেল। এই পৃথিবীর বুকে আঁধার নামার পালা এবার। সেতু পার হয়েই রাস্তার ধারে বেশ কিছু নতুন দোকান হয়েছে বলে জানতে পারলাম। চা, কফি , বা কোনও দোকানে নানারকম ভাজাভুজি, অথবা কেক, বিস্কিট, লজেন্সের দোকান। পরিচ্ছন্ন একটি দোকান থেকে চা নিয়ে সেতুর ধারে এসে দাঁড়ালাম । বেশ সুন্দর হাওয়া বইছে। একে একে আলো জ্বলে উঠছে। দিনের শেষে সন্ধ্যা নামল। তিস্তার বুকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। অনেক দূরে তিস্তা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে এখন আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে ভিনদেশেও আঁধার নামল।
পরদিন সকালে আমাদের মেখলিগঞ্জকে বিদায় জানানোর পালা। হলদিবাড়ী থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাব প্যাসেঞ্জার ট্রেনে। স্টেশনে গিয়ে টিকিট কাটতে হবে। আশ্রম অধ্যক্ষ মহারাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম। আশ্রম কর্মী টোটোর ব্যবস্থা করে দিলেন। আবার আমার সেই ভাইটি! চওড়া এক মুখ হাসি নিয়ে সে তৈরী তার বড়দি আর দাদাবাবুকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে। টোটোতে আমাদের সহযাত্রী রয়েছেন ভাইটির জেঠিমা। হাতে তাঁর ছোটখাটো একটি কাপড়ের পুঁটুলি। দেখা হওয়া মাত্রই জেঠিমা আমার উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রশ্ন করে ফেললেন। টোটোয় জেঠিমার পাশে বসতে বসতেই যথাসম্ভব উত্তর দিলাম। এবার টোটো চলতে শুরু করল , সঙ্গে শুরু হল জেঠিমার নিজের সংসারের গল্প। তাঁর পরিবারের বোধহয় সব সদস্যদের নাম জানা হয়ে গিয়েছিল সেদিন ( যদিও মনে নেই)। প্রত্যেকের সঙ্গে কার কি সম্পর্ক সেও শুনতে হল। আমি বোবা হয়েই ছিলাম। নিজের বুদ্ধিমত্তা বা স্মরণশক্তির উপর ভরসা কমতে শুরু করেছে তখন। এত কথা– কিছুই মাথায় থাকছে না। অত কথার মাঝে জেঠিমা আমার ভাইটিকে দিয়ে বারবার কাউকে ফোন করানোর চেষ্টা করছিলেন। অপরদিকের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ভাইটি বারবার টোটো থামিয়ে ফোন করবার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। আমরা উশখুশ করছি। যদি দেরী হয়ে যায় , ভেবে। ভাইটি বলল, 'কিছু চিন্তা করতে হবে না। ট্রেনে তোমাদেরকে বসিয়ে তবে আমি ফিরব। জেঠিমাও তো যাবে ঐ ট্রেনেই। ' তা সত্যিই, দেরী মোটেও হয় নি। আমাদের দু জনকে টোটোতে বসতে বলে ভাইটি গিয়ে টিকিট কেটে আনল। এইবার প্ল্যাটফর্ম এ যেতে কোনও অসুবিধা আর হয় নি। ট্রেন আসতেই জেঠিমা আমার আর আমার স্বামীর জন্য জানলার ধারে দুটি সীট আগেই পুঁটুলি আর জলের বোতল রেখে দখল করেছিলেন। নিজে অন্য কোথাও বসেছিলেন। আর ভাইটি জিনিসপত্র। ট্রেনের টিকিট আর টোটোর ভাড়া ছাড়া আলাদা পয়সা সে কিন্তু কিছুতেই নিতে রাজী হল না। বললাম, বড়দি বলে ডাকলে। কিছু তো নাও। নিজের পছন্দের জিনিস কিনে নিও বড়দির নাম করে। সে বলল, ' আবার এসো দিদি আমাদের মেখলিগঞ্জে, তাহলেই হবে। আর পরের বার আমাদের গ্রামে তোমাদের নিয়ে যাব। ' ট্রেন ছাড়তে জানলা দিয়ে দেখলাম ভাইটি হাত নেড়ে যাচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্যে। মনের মধ্যে একটা ছোট্ট 'মন খারাপ' উঁকি দিয়ে গেল । আসার দিন রেডিওতে শুনেছিলাম যে গানটি সেটি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল " তোমায় হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না" –
ট্রেনে বসে মোবাইল নেট পরিষেবা চালু হতেই খবর পেলাম বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ফলস্বরূপ ৬ জন ভারতীয় ও নেপালের ছাত্র 'তিন বিঘা করিডোর' পার করে ভারতবর্ষে এসেছেন বাধ্য হয়ে আগের দিনই । পরবর্তী কয়েকদিনে সকলেই জেনেছি এই ভয়ানক আন্দোলনের কথা। শিউরে উঠেছি।
এ আমার এক অন্যরকম ভ্রমণের কথা । অর্থের লোভ যে কী সাংঘাতিক সকলেরই জানা আছে। অভাব আর লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ দুষ্কর্ম করেই চলেছে । সেতু তৈরী হয়েছে। নিঃসন্দেহে উন্নয়নের বড় পদক্ষেপ। কেউই উন্নয়ন বিরোধী নয়। কিন্তু এই উন্নয়নের নেশায় এরপর সবুজের সমারোহ থাকবে তো? কেমন যেন সন্দেহ হয়। সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ জন খুব একটা শান্তিতে থাকেন কি না জানা নেই। মেখলিগঞ্জের লোকসংখ্যা খুব কম এমনিতেই। ভবিষ্যৎই বলবে এই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তরের ভাগ্যের কথা।
*ছাত্রী ১৯৮৯
খুব ভালো লাগলো। দারুন লেখা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনবাহ্ খুব ভালো
মুছুনভারী সুন্দর লেখনী ....মনে হচ্ছিলো দেখতে পাচ্ছি মানসচক্ষে
উত্তরমুছুন...ট্রেন থেকে অবতরণের বর্ণনাটি হাস্যরসের অনুভূতি আনে. আমি দু বার পড়লাম ..., আমার সহকর্মী কে পড়ে শোনালাম ..., ওই রকম পরিস্থিতি তে পড়লে ...এই বুড়ো বয়েসে আমার ঠ্যাং আস্ত থাকবে না ...
যাইহোক সদ্যপ্রাপ্ত ভাই কিন্তু খুব হেল্পফুল..সচরাচর পাওয়া যায় না.
সানিয়াজযান নদী র নাম টা ভারী সুন্দর ...
ধন্যবাদ
মুছুনলেখা টা পড়লাম, খুব ভাল লাগল ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনঅপূর্ব লেখনী
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো হয়েছে এই অনন্য ভ্রমণ কাহিনী,
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনদারুণ লেখা ....বরাবরের মতোই এবারেও খুব সুন্দর একটা লেখা পেলাম। মাঠঘাট, ক্ষেতখামারের বর্ণনা...সবেতেই সবুজের ছোঁয়া পেলাম। নতুন পাওয়া ভাইটিও তোমার দারুণ !
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনএমন কঠিন পথের অনাবিল সৌন্দর্যে মন প্রাণ ভরে গেল। অসামান্য সব ছবি আর এত সুন্দর বর্ণনায় মুগ্ধ হলাম।
উত্তরমুছুনআগামীর জন্য শুভকামনা রইলো।
(কস্তুরী )
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন