নদী বক্ষে নিরঞ্জন

     আত্রেয়ী দাস
 

আজ বৃহস্পতিবার ২রা অক্টোবর ২০২৫ সালের বিজয়া দশমী। এই বছরের মতো দূর্গা পূজোর সমাপ্তি পর্ব। গতকাল রাত থেকেই মনে হচ্ছিল যেন আগামীকাল বিজয়া দশমী পর্বটা কোথাও একটা গঙ্গা বক্ষে বা নদী বক্ষে দেখতে গেলে খুব ভালো হতো। সেই কথা আমার মা কে বলেছিলাম উনি চুপ করে শুনে ছিলেন। হঠাৎই আজ সকালে মা বললেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আমরা এখনি বেরোবো। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি মা কে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন, ‘কয়েক ঘণ্টা বাদে সব জানতে পারবি’। যথারীতি শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠে আমরা পৌঁছে গেলাম উত্তর ২৪ পরগণার টাকীতে । ওখানে ইছামতী নদী বক্ষে অসাধারণ প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় সেটা শুনেছিলাম। আজ আমি প্রায় ১৫ বছর পর সেখানে গেলাম। নদী বক্ষের কাছেই অনেকদিনের একটি পুরানো স্থানে যেতে পেরে খুবই আনন্দ হচ্ছিল। সকাল থেকেই আমরা একটি বিখ্যাত জমিদার বাড়ি “পূবের রাজবাড়ী তেই “ রয়েছি। সমস্ত রকম সাবেকিয়ানার প্রথা মেনে এই বাড়িতে চলছে প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি পর্ব। আমি দেখতে পাচ্ছি একদিকে অসাধারণ সুন্দর সাবেকিয়ানায় সাজানো মা দুর্গাকে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে লাল পাড় হলুদ শাড়ি পরিহিতা মহিলা ঢাকীদেরও। ওই বাড়ির প্রধান সদস্যরা বাড়ির প্রথা মেনে নীল কন্ঠ পাখি ওড়ালেন এবং তার সাথে দেখতে পাচ্ছি মা দুর্গাকে পান্তা ভাত এবং কচু শাক রান্না করে দেওয়া হয়েছে। সব পর্ব মিটে যাওয়ার পরে বাড়ির মহিলারা একপ্রকার চোখের জলে মা কে বিদায় জানালেন। তারপর ইছামতি নদীতে অনেক আগে থেকেই নৌকা ভাড়া করা ছিল। পরপর দুটি নৌকা। একটি তে প্রতিমা এবং ঢাকি সমেত কয়েকজন উঠলেন এবং অন্যটিতে মহিলা সদস্যরা বসে নদী বক্ষে পরিক্রমা করলেন। ওপার থেকে বাংলা দেশের দুর্গাপ্রতিমাও এসে গেছে। যথারীতি এপারে বি. এস. এফ  এবং ওপারের বি. ডি. আরের ব্যবস্থাপনায় দুই দেশের প্রতিমা নিরঞ্জন হলো। মাঝে কয়েক বছর এই প্রতিমা নিরঞ্জন নদী বক্ষে বন্ধ ছিল। কিছু আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য। কিন্তু আজ তিন বছর ধরে আবার শুরু হয়েছে এই প্রতিমা নিরঞ্জন। ইছামতি নদীর পুরো  এলাকা জুড়ে সি. সি ক্যামেরায় মুড়ে ফেলা হয়েছে। চারিদিকে আলোর রোশনাই দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার ঘেরাটোপের মধ্যে এ বছরের মতো দুই দেশের ঢাকের বাদ্যিতে, জওয়ানদের পায়ের ভারী বুটের আওয়াজ চাপা পড়ে গিয়েছিল। আমার মায়ের মন কিছুক্ষনের জন্য ভারী হয়েছিল কারন আগের মতো নদী বক্ষে দুই দেশের মেলবন্ধন কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে গেছে। ১৫ বছর আগের টাই ভালো ছিল। প্রতিমা বিসর্জনের পর ডাঙায় উঠে একে অপর কে মিষ্টি খাওয়ানো থেকে শুরু করে দুই হাত জোড় করে শুভ বিজয়া জানানো পুরো  পর্বটা ই মনে রাখার মতো ছিল। অচেনা, অজানা মানুষের সঙ্গে কিছু সুন্দর মূহুর্ত কাটানো টাই অনেক বড়ো পাওনা। যাইহোক এ বছর নিরঞ্জন  পর্ব খুব একটা খারাপ ছিল না। আগের থেকে নদীর নাব্যতা অনেক কমে গেছে, পলি ভরাটের জন্য। তাই প্রতিমা বিসর্জনে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। নিজের চোখে নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে পেরে মনটা খুশীতে ভরে গেল। সবটাই সম্ভব হলো আমার মায়ের জন্য। প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে আমরা আবার কলকাতায় ফিরে এলাম। পরের বছর অবশ্যই কলকাতার থিম পূজো থেকে কয়েক মূহুর্ত বেরিয়ে গিয়ে কিছু রাজবাড়ী, জমিদার বাড়ির সাবেকিয়ানার পূজো তে  অংশগ্রহণ করবো বলে ঠিক করেছি। আমার মায়ের মামাবাড়ি টাকী অবশ্যই অবশ্যই যাবো, ছাড়ছি না। 


**ছাত্রী, প্রথম অর্ধবর্ষ, ২০২৫
ভূগোল বিভাগ, উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান কলেজ

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা