নীলচে রোদ্দুর..

 

-                      কস্তুরী দাশ





সবুজ আস্তরণ পড়া জলে, সরের মতো ভাসছে সময়।

নীলচে রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে উঠোন আর গাছপালা ঘেরা সেই সবুজ বাড়িটা। সেই রোদ্দুরে ছিপ ফেলে বসে থাকে এক মেয়ে, ফেলে আসা সময়টার দিকে তাকিয়ে। যদি ধরা যায়..

 ফিরবে না, সেকি ফিরবে না..

 গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আসা সেই নীলচে রোদ্দুরে

স্মৃতির আঁকিবুকি..

                     " আয়ে গা বোলে গা "....

বিকেল গড়ালেই তার আগমন। রোগা, লম্বাটে চেহারা, বাঁ হাতে একটা কাঁচের বয়াম তাতে চূড়ন ভর্তি। পকেটে রাখা ছোট ছোট কাগজের টুকরো, তাতে করেই হাতে হাতে চূড়ন দেওয়া। দাম ১০ পয়সা।

ঠাকুমার পয়সা রাখার বই-কৌটো খুলে পয়সা নিয়েই ছুট। "আমাকে দাওনা ".. ততক্ষণে বন্ধুদের জটলা, ছোট ছোট হাত বাড়িয়ে সবাই। এক এক চামচ চূড়ন ওই সাদা কাগজের টুকরোতে এক বিশেষ কায়দায় মোড়া। নিমেষেই শেষ।

লোকটা চলে যাচ্ছে.."আয়ে গা.. বোলে গা..." সুরে হেঁকে হেঁকে। ঢোলা প্যান্ট, ফরসা জামা। ধোপদুরস্ত।

চলে গেল অনেক দূরে.. জানিনা কোন সুদূরে..

 সন্ধ্যে হলেই বেল ফুইইইল..

 চৈত্রের সন্ধ্যেবেলা গোটা পাড়ায় ম' ম সুগন্ধ।

মা কিনে নিল অনেকগুলো। ঘরে ঘরে সুগন্ধের হিল্লোল।

কেমন ভেসে বেড়ানো সময়। চাপ হীন , ক্লান্তি হীন এক অমোঘ সময়।

চলে গেল অনেক দূরে..জানিনা কোন সুদূরে..

 ডিমওয়ালার ঘড়ঘড়ে গলার আওয়াজ। ছোট্ট মেয়েটা একটু ভয় পায়। দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। ঠাকুমা ডিম গুণে নেয়। "এক দুই তিন.. থাক এই দশটাই থাক। না না আর দিওনা, আর দিও না।"

".. তা, তোমার বাড়ির খবর কী.. ছেলেমেয়েরা সব..."

ডিমওয়ালা ময়লা ফতুয়ায় চোখ মোছে। কেন!.. কে জানে!..

ঠাকুমা তার পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিল .. কে জানে!.. কেন যে!..

চলে গেল অনেক দূরে.. জানিনা কোন সুদূরে..

 মাথায় সাদা টুপি, সাদা ধুতি, খাটো পাঞ্জাবী তে, ফর্সা টকটকে পাঁপড় ওয়ালা। কী মেজাজ!.. এক দু টাকার পাঁপড় নেবে!.. ছ্যাঃ.. ছ্যাঃ

ঠাকুমার মুখ মুষড়ে যায়।

জ্যাঠাদের আলাদা সংসার। অনেক বাহুল্য। ওরা মোটে তিনজন। প্যাকেট ভর্তি পাঁপড়, আচার, বড়ি সব কিনে নেয়।

পাঁপড়ওয়ালা.. তোমাকে চাইনা.. চাইনা।

তবুও..

চলে গেল অনেক দূরে.. জানিনা কোন সুদূরে..

 চালউলি। আলতার মা। লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে ওই বিরাট বস্তা মাথায় করে। ঠাকুমা ওর কাছে 'বুড়ো মা'। ছোট্ট মেয়েটার মন খারাপ হয়ে যেত। " কেন বল কেন,' বুড়ো মা'.. একদম বলবে না। "

"কেন, বলবো না কেন!.. দেখছো না কেমন শনের মতো সাদা চুল!..বুড়ো মা বলবো না তো কী!"

অজানা আশঙ্কায় বুক ঢিপ ঢিপ করে মেয়েটার। বুড়ো হলেই তো মানুষ মরে যায়। ঠাকুমাও যদি..

হাপুস নয়নে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দেয় সেই মেয়ে।

আলতা দূরে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসে।

বেশ কয়েকমাস চালউলি আসেনা । তারপর একদিন বুক ভাঙা কান্না নিয়ে আলতা র মৃত্যু সংবাদ নিয়ে হাজির হয় সে।

চলে গেল অনেক দূরে.. জানিনা কোন সুদূরে..

 ভাঙা কাঁসরের মতো গলার আওয়াজ। গুড়ওয়ালা। জ্যাঠারা পাটালি, মোয়া, গুড় সবই কিনে নিত। ঠাকুমা কিনতো শুধু নলেন গুড় এক নাগরি। তাতেই কতো দর কষাকষি, রাগারাগি অবধি। গুড়ওয়ালা বুঝতো, সাধ আর সাধ্যের তফাৎ। শেষমেশ ঠাকুমার দামেই রাজি।

গুড়ওয়ালার অনুরোধ আজও কানে বাজে, " নাও না মা.. অল্প করেই না হয় নাও। "

চলে গেল অনেক দূরে.. জানিনা কোন সুদূরে..

 সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসেই, সেই ডাকে প্রাণ ছটফট।

"ঘুঁঘনি.. আঁলুরদম".. বেঁটে গোলগাল চেহারায় চন্দ্রবিন্দু সর্বস্ব ঘুগনিওয়ালা। শালপাতায় করে এক হাতা ট্যালট্যালে ঘুঘনি আর ছোট ছোট দু পিস আলুরদম। মোট দু টাকা। উফফ কী স্বাদ!..

চলে গেল অনেক দূরে.. জানিনা কোন সুদূরে..

 মনে হয় গতজন্মের কথা। অমন স্বাদে-আহ্লাদে ভরা জীবন কখন চলে গেছে শব্দহীন পায়ে, আনমনে। দূরে দাঁড়িয়ে সে দেখে.. ইশারাতে ডাকে.. স্বপ্নে খাতা খুলে দেখায় সেইসব ফেলে আসা দিনের রঙীন জলছবিগুলো। স্মৃতির সরণী ধরে তারা ফিরে ফিরে আসে জীবনের গোধূলিতে।

মধ্যবয়সী মন খুঁজে ফেরে তোবড়ানো টিনের বাক্সোয় সেই দড়ি বাঁধা লাট্টু, রান্নাবাটির মাটির শীল-নোড়া, বঁটি, আয়না, ড্রেসিং টেবিল, কাঁচ বসানো আলমারির আয়নায়, বয়ে চলা সময়ের দিকে তাকিয়ে।

 ফিরবে না সেকি ফিরবে না

ফিরবে না আর কোনোদিন..


**ছাত্রী, ১৯৯৪

ভূগোল বিভাগ, উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান কলেজ




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা