বনেদি বাড়ির পুজো পরিক্রমা
স্নেহা দাস
এখন বন্ধু বান্ধবীরাই পুজোয় ঠাকুর দেখতে যাই। আমি এই পুজোতে অনেক ঠাকুর দেখেছি , সব দিনগুলির মধ্যে আমার এবছরের ষষ্ঠীর দিনটি ছিল সব থেকে আলাদা। আমি আমার বান্ধবীদের সঙ্গে গিয়েছিলাম উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো পরিক্রমা করতে। সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম, হাতে ক্যামেরা আর মন ভরা উচ্ছ্বাস! মেট্রোয় চেপে, হাসি-ঠাট্টায় ভরা গপ্পো করতে করতে আমরা নেমে পড়লাম গিরিশ পার্কে। কলকাতার পুরনো বনেদি বাড়িগুলোর সেই রাজকীয় সাবেকি সাজ, ধূপের গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ — সব মিলিয়ে একেবারে অন্যরকম অনুভূতি।
প্রথম গন্তব্য ছিল জোড়াসাঁকোর বন্দুকওয়ালা দাঁ-বাড়ি— বাইরে থেকেই তার পুরনো রাজকীয় ভাব মুগ্ধ করে। এখানকার পুজো শুরু হয়েছিল ১৮৫৯ সালে, দাঁ পরিবারের স্বর্গীয় নরসিংহ চন্দ্র দাঁর উদ্যোগে, যিনি নিজের ঠাকুরদালানে এই ঐতিহ্য শুরু করেন। এখানকার পুজোয় এখনও গান স্যালুট দেওয়া হয়, একেবারে পুরনো দিনের রাজবাড়ির ছোঁয়া! দেবীর গয়নাগুলো সত্যিকারের সোনার-রুপোর, আর পুরো বাড়িটা যেন ইতিহাসের গন্ধে ভরা। আমরা সবাই মিলে প্রচুর ছবি তুললাম — পুরনো উঠোন, বড় বড় খিলান, আর সেই ধুনুচির ধোঁয়ায় ভরা পরিবেশটা একদম অন্যরকম অনুভূতি দিল। এখানে পুজোর ৫দিন বসিয়ে প্রসাদ খাওয়ানোর প্রথা আছে।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম জোড়াসাঁকো শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে। এখানেও পুজোয় ভক্তির ছোঁয়া, ঐতিহ্য আর নান্দনিকতার মেলবন্ধন। এই বাড়ির পুজোও উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলে আসছে — প্রতিমা সাজানো থেকে শুরু করে ভোগের থালা, সবকিছুতেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে দাঁড়িয়ে দরজার বাইরে দিয়ে আমরা দেবীর বোধন দেখলাম, দেখলাম কিভাবে ঠাকুরমশাই এর নির্দেশে একজন মায়ের হাতে অস্ত্রদান করছে। মা সেজে উঠলেন রনংদেহী রূপে।
এত হাঁটাহাঁটির পর স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা পেয়ে গেল! রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা, আইসক্রিম , কোল্ড ড্রিঙ্কস খেলাম, বান্ধবীদের হাসির হুল্লোড়ে রাস্তা জমে উঠেছিল।
শেষ গন্তব্য — কুলুটোলার বদন চন্দ্র রায় বাড়ি। নাম শুনেই বোঝা যায় — এটাই এখনকার ইনস্টাগ্রাম-চর্চিত বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো। বিশাল ঠাকুর দালান, আলোয় ঝলমলে প্রতিমা, আর অসংখ্য মানুষের ভিড়। এখানকার পুজো শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে, এবং আজও তা একই আভিজাত্য বজায় রেখে চলে আসছে। বৈষ্ণব প্রথা অনুযায়ী এখানে পশুবলি হয় না, বরং সন্ধিপুজোর সময় ১০৮টি নারকেল, চাল ও চিনি উৎসর্গ করা হয় — ভাবলেই অবাক লাগে, কত পুরনো ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে!
এখানে গিয়ে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়, পুজো নিয়ে নানা ব্যপারে তিনি আমাদের মতামত জানতে চান। আমরা বনেদিবাড়ির পরিক্রমার সম্পর্কে তাকে জানাই এবং তিনিও বনেদিবাড়ির সংস্কৃতি সম্পর্কে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, যা পুরনো কলকাতার মনোমুগ্ধকর স্মৃতি ধরে রাখে। রাত বাড়তে শুরু করেছিল, কিন্তু মন ভরে গেল সেই দিনটা। পুরনো কলকাতার গলিতে গলিতে ঘুরে আমরা যেন সময়ের মধ্যে ফিরে গেলাম — যেখানে দুর্গাপুজো শুধু উৎসব নয়, ঐতিহ্যের নিঃশব্দ গল্পও।
**ছাত্রী, পঞ্চম অর্ধবর্ষ, ২০২৫
ভূগোল বিভাগ, উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান কলেজ








মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন