যা হারিয়ে যায়....
কস্তুরী দাশ
জীর্ণতার একশেষ।
দিনের
আলো, রাতের আঁধার, গোধূলির মায়া সবই, এই ভুবনের বাইরে।
জানলা দরজাহীন এক নড়বড়ে পরিকাঠামো।
যেকোনো মুহূর্তে নিজেকে উজাড় করে মাটিতে মিলিয়ে দিতে পারে সে। তবু, টিকে থাকার অদম্য বাসনায়, জীর্ণ শরীরেও রাজকীয় অহংকার মেখে তার অদৃশ্য জয় পতাকা, দূরের
কোনো পথিক কে আহ্বান করে।
একবার
দেখে যাও, ছুঁয়ে যাও আমায়!..কথা বলো, কাছে এসো.. খুঁজে নাও আমার অন্ধকারের অতলে ডুবে যাওয়া সেই সিঁড়ি। উঠে এসো সেই অলিন্দে, যেখানে মহীরুহ
নিজেদের বিস্তৃতির ঘনঘটায় আছন্ন। তার ডালে ডালে পাখির বাসা, প্রজাপতিদের সংলাপ। নড়বড়ে থামের খাঁজে উঁকি দিচ্ছে শ্বেত আকন্দ, ধুতরো।
দিনের
আলোয় হাওয়াদের হাহাকার। পাল্লাহীন দরজা জানলার পরিসীমায় অনায়াস তাঁদের যাতায়াত।
এ
তো বাইরের দলিল।
চোখের আলোয় যা উদ্ভাসিত।
যা
দেখা গেলোনা, তা যে অপরিসীম
সত্য!..
গমগমে
ভরা ভর্তি এক রাজকীয় প্রাসাদ।
জমিদার, নায়েব, বরকন্দাজ, হাতি, ঘোড়া, বন্দুক, শিকার, আলোর রোশনাই, ঝাড়বাতির উজ্জ্বল অহংকার, বিরাট বিরাট দরজা জানলায় রঙিন কাঁচের আশ্চর্য বিচ্ছুরণ!..মেঝের গালচে, মিনে করা আতরদানি, হাতির দাঁতের কারুকার্য করা বিরাট পালঙ্ক, রুপোর ঝালোর দেওয়া হাত টানা পাখা, ধবধবে ফরাসি চাদর বিছানো বিছানা, দাস দাসী নফর চাকর। রাতের আঁধারে এস্রাজের সুখ নিদ্রা। সবই ছিল।
আছে
তো..
যা
আছে, তা কালের নিয়ম।
এখন
সবাই রাজা। এখন সবাই চাকর।
এখন
সবাই শিকারি। এখন সবাই শিকার।
ফরাসি
আতর দূরের পানে পথ হারিয়েছে। উঠোনের
একপাশে শরতের আলো। ঝরে পরা শিউলির আনন্দ-বেদনা। শিউলির মৃদু সুবাসে বিরাট ওই নড়বড়ে ইমারত
শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলে। এস্রাজের সুর গেছে থেমে। তবু কোনো রাতচরা পাখির সুরে ভেসে যায় ওই ভগ্ন ইমারতের
হৃদয় অলিন্দ। সুখের নয় আজ শান্তির
আয়োজন হয়েছে সারা।
সবই আছে।
মহিরুহের শিকড়ে শিকড়ে সব কথা বিস্তৃত হয়ে আছে।
সোহাগী অনন্তলতা প্রেমে, উষ্ণতায় জড়িয়ে রেখেছে তাকে। অমাবস্যায় এই ইমারতে জ্বলে ওঠে বিন্দু বিন্দু আলো। জোনাকিরা আলো নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এ ঘর থেকে ও ঘর, কুঁয়ো তলায়, উঠোন পেরিয়ে নাচ ঘরের অন্তিম অন্ধকারে।
কোজাগরী পূর্ণিমার আলোয় লক্ষ্মী আসেন ধীর পায়ে। লক্ষ্মীর সোনার কলস ঠিকরে আলোয় আলো হয়ে ওঠে চারপাশ।
যাবতীয় অহংকার ত্যাগ করে নির্লিপ্তির সাধনাই, আজ তার একমাত্র ব্রত।
বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার বোলপুর শ্রীনিকেতন ব্লকের রাইপুর-সুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে 'রাইপুর' গ্রাম। এই গ্রামেরই জমিদার বাড়ি, যা 'রাইপুর রাজবাড়ী' বলেই অধিক প্রসিদ্ধ।
১৮৬৩
সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০ একর জমি
দুটি ছাতিম গাছ সহ বার্ষিক ৫
টাকার বিনিময়ে তৎকালীন জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ইজারা নেন, এবং শান্তিনিকেতন নামে একটি অতিথিশালা গড়ে তোলেন।
বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য 'শান্তিনিকেতন' গড়ে ওঠার পেছনে এই বাড়িরই অবদান।
মনে
করা হয়, এই অঞ্চলে প্রথম
আসেন, লাল চাঁদ সিংহ। ওনারা মেদিনীপুরের বাসিন্দা ছিলেন। উনি এখানে আসেন, মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে ব্যবসা করার জন্য।
১৭৬৪
সালে তাঁরা মেদিনীপুর থেকে ১০০০ ঘর তাঁতি নিয়ে
এই রাইপুর গ্রামে আসেন। তাঁতের কাজকর্ম শুরু হয়। সেইসব তাঁতে বোনা জিনিস বিদেশে রপ্তানি হতো।
সেইসময়
রেল, সড়ক হীন অবস্থায়, একমাত্র নদীপথই ভরসা ছিল।
এই
রাইপুর গ্রামের অনতিদূরেই অজয় নদ। সেইসময় অজয় নদের নাব্যতা ছিল খুব ভালো। সেই নদী পথেই ব্যবসা বাণিজ্য চলতে থাকে।
জানা
যায়, ১৭৭০ সালে ওনারা এখানে জমি জায়গা কিনে এই বাড়ি তৈরী
করেন। সেই হিসেবে প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশী ইতিহাস।
চারটি
বড় বড় পুকুর নিয়ে
প্রায় ৬০ বিঘা জায়গা
জুড়ে এই জমিদার বাড়িটি
তিনটি ভাগে বিস্তৃত।
যে
বছর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন স্থাপন করেন, সেই বছরই অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই বাড়ি কৃতি
সন্তান সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ, যিনি তাঁর নানান কার্যাবলীর মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় সুপরিচিত হয়ে আছেন। ১৯১৯ সালে প্রথম
ভারতীয় হিসেবে ব্রিটিশ হাউস অফ লর্ডস এর
সদস্য নির্বাচিত হন। এবং ১৯২০ সালে বাংলা ও বিহারের গভর্নর
নিযুক্ত হন।
ইতিহাস এখানেই থেমে থাকেনা। আরো অনেক অনেক ইতিহাস এই বাড়ির পরতে পরতে। যা অনেকেরই জানা।
দুর্গাপূজোর
নবমীর সকালে পৌঁছেছিলাম এই বাড়িতে। সকাল
৮ টার এক নিস্তরঙ্গ রোদ্দুরে,
গহন ছায়া
মাখা এই জমিদার বাড়িটি
যেন ধ্যানমগ্ন তপস্বী, যার ভিতরে বাহিরে মহাকালের স্রোত, অনন্ত কালের ভাসমান গতিতে বিলীন হবার অপেক্ষায় দিন গুনছে।
বাংলার পুরনো হারিয়ে যাওয়া কত কথা! – লেখিকার লেখনীর মাধ্যমে, ছবির মাধ্যমে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এমন সব লেখা ও ছবি মনকে ভাবতেও সাহায্য করে।
উত্তরমুছুনআরোও এমন লেখার অপেক্ষায় থাকছি।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই 🙏🏻
মুছুনসুন্দর বর্ণনা।
উত্তরমুছুনসেরা লাইন - এখন সবাই শিকারী, এখন সবাই শিকার 👍👍
লেখার পর আমারও এমনটাই মনে হচ্ছিল। তুই সেই সংশয় কাটিয়ে দিলি। অনেক থ্যাংক ইউ রে ❤️
উত্তরমুছুনচমৎকার বর্ণনা ।যেন লেখিকার কল্পনার সূক্ষ্ম তুলির টান।আরো লেখার অপেক্ষায় থাকলাম
উত্তরমুছুনআন্তরিক ধন্যবাদ 🙏🏻
মুছুন