এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

মৌসুমী ব্যানার্জি







হাইওয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে চলেছে আমাদের বাস, ২৪ জন ভারতীয় যাত্রীকে নিয়ে। সঙ্গে আছেন আমাদের ট্যুর গাইড। ভারতীয় একটি নামী ট্যুরিস্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় এই বেড়ানো। এই দলে আমরা ছাড়াও দুর্গাপুরের একটি বাঙালী পরিবারের তিনজন সদস্য আছেন। বাকিরা উত্তর দক্ষিণ ভারতের। দলে দক্ষিণীরাই সংখ্যায় বেশী।

 

শুরু হয়েছে লণ্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে। গত দশদিনে লণ্ডন ,সেখান থেকে বিশ্বের দ্রুততম ইউরো স্টারে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে প্যারিস, প্যারিস থেকে ব্রাসেলস হয়ে আমস্টারডাম ঘুরে, জার্মানির কোলন ক্যাথিড্রাল দেখে এক রাতের ঠিকানা হয়েছিল ম্যানহেম।

 

ইউরো স্টারে প্যারিস পৌঁছতেই সাদা ধবধবে রঙের, বড় বড় কাচ আঁটা জানলার মার্সিডিজ বেনজ্ - এয়ারকণ্ডিশন্ড বাসটি আমাদের সারাদিনের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। দেশের নিয়ম অনুযায়ী বাসের বাঁদিকে স্টিয়ারিং হাতে বসে আছে স্বাস্থ্যবান, লাজুক যুবক, ড্যানিয়েললিথুয়ানিয়ার বাসিন্দা সে। বাসের পেট ভর্তি আমাদের যথা সর্বস্ব মানে ব্যাগ, স্যুটকেস ছাড়াও আমাদের সকলের দায়িত্ব তার কাঁধে। প্রত্যেক দিনই স্থানীয় সময় সকাল টায় আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ড্যানিয়েল নতুন নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যেকখনও একই দেশে, কখনও অন্য দেশে।

 

Blackforest এ ছোট্ট সবুজ পার্ক এ রঙীন কাঁচ দিয়ে তৈরী  ফুল, পাখি

আজ আমাদের আপাততঃ গন্তব্য Blackforest. আমাদের বাস ছুটে চলেছে Blackforest Holiday route – German Clock Route ধরে। পৌঁছলাম সেই গ্রামে যেখানে Cuckoo clock তৈরী হয়। ঘন নীল আকাশের নীচে ঘন সবুজ পাইনের জঙ্গলে ঘেরা Hofgut Sternen নামের ভারী মিষ্টি, সুন্দর একটি গ্রাম। এমন গ্রামের ছবি দেখেছি বইয়ের পাতায়। ট্যুর ম্যানেজার বিশাল এক  দোতলা বাড়ির সমান উঁচু ঘড়ির সামনে দাঁড় করালেন। ছোটবেলায় Nursery Rhymes অথবা Fairy tales বইয়ের পাতায় এমন ছবি দেখতাম বলে মনে পড়ল। একটু পরেই আমাদের সকলের ঘড়িতে দুপুর সাড়ে বারোটা বাজতেই বিশাল ঘড়ি থেকে বেরোল দিব্যি সুন্দর ছোট্ট পাখি এবং আরোও সুন্দর করে নির্জন পরিবেশে কু-- কু-- করে ডেকে ঘড়ির ভিতর কোথায় পালিয়ে গেল। তারপরেই ঘড়ি থেকে বেরিয়ে এল নৃত্যরত দুটি মানুষসঙ্গে টুং টাং পিয়ানোর ধ্বনি। ঘড়ি, পাখি, মানুষ সবই কাঠের। ভালো লাগল বেশ।

Cuckoo clock  – দোতলা বাড়ি একটি

নানারকমের পাখি দেওয়া ঘড়ি বিক্রি হচ্ছিল সেখানে, দেখা হল, অনেক কিছু জানাও হল , কেনা অবশ্য হয় নি। পাশেই আরোও একটি দ্রষ্টব্য বিষয় – Sternen Glass– Glas Manufaktur . সেখানে পুরনো পদ্ধতিতেই নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে কাঁচ দিয়ে তৈরী হচ্ছে অসামান্য সুন্দর ঘর সাজানোর সরঞ্জাম। এক পাশে দেখানো হচ্ছে কিভাবে তৈরী করা হয় এমন সব রঙীন মনোমুগ্ধকর জিনিসগুলি।


কিছুক্ষণ পরেই বাস থামল Titisee lake অঞ্চলে। Indian Palace হোটেলে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। সেখান থেকে ঘন্টা খানেক বাদে যাত্রা শুরু। গন্তব্য Engelberg – জার্মান ভাষায় যার অর্থ 'angel's mountain'. নামটি উচ্চারণ করলেই কি এক ভালোলাগা যেন মনকে ছুঁয়ে যায়। আমাদের গোটা দলটাই সেদিন কেমন এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সকাল থেকে। ঘন্টা আড়াই লাগবে পৌঁছতে। মাঝখানে নামা হবে রাইন ফলস্ দেখতে এবং কিছুক্ষণ জুরিখ এ।  রাইন ফলস্ রাইন নদীর উৎস। সেখানে boat ride ব্যবস্থা আছে ফলস্ এর কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য।

ইওরোপে পৌঁছে অবধি আকাশের নীল রঙ দেখে আমরা সকলেই অবাক হয়ে ছিলাম। এইদিন সকাল থেকে আমরা চলেছি শহর ছেড়ে। বাসের বড় বড় কাঁচ দিয়ে আকাশের নীল আর গাছপালা ঘাসের সবুজ রঙ দেখে সকলেই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কুচকুচে কালো মসৃণ রাস্তা ধরে বাস ছুটে চলেছে। Titisee থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর থেকেই পাশে বয়ে চলেছে খরস্রোতা রাইন নদী। তার স্বচ্ছ জলে আকাশের নীল রঙ। সুনীল আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের রেখা আর অমন নীল দিগন্ত জুড়ে পাইনের ঘন সবুজ জঙ্গল রাস্তার অপর পারে বাসের জানলায় চোখ রেখে চুপ করে বসে আছি। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে কথা বলবার ইচ্ছা আর করে না। শুধু আমি নইপ্রায় সকলেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ!

 

রাইন ফলস্ পৌঁছিয়ে বাস থেকে একে একে নেমে ঢালু পথ বেয়ে নেমে এলাম নদীর ধারে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলনদী গর্ভের পাথরও দেখা যাচ্ছে। এর আগে মেঘালয়ের ডাউকি তে দেখেছিলাম স্বচ্ছ নদী। সেখানে জঙ্গলের গাছপালার রঙে সে নদী সবুজ রঙা। নদীর প্রেম, সখ্যতা সবই নীলরঙা আকাশের সঙ্গে। তাই তার জল গাঢ় নীল রঙা। সেই নীল জলে রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীর ধারে আমাদের দেখে ওরা এগিয়ে এল। খাবার চাইছিল। কিন্তু আমরা বাসে সব জিনিস ছেড়ে এসেছি। কিছু দেওয়া গেল না। এবার এগোন হল জেটির কাছে। একটি নৌকো আমাদের পুরো দলের জন্য

 

রাইন ফলস্ এ

নৌকো তে বসে অবাক হয়ে দেখছি জলের অদ্ভুত নীল রঙ আল্পস্ পর্বতের রোন (Rhone) হিমবাহ এই জলের উৎস। সে পাহাড়ে যুগ যুগ ধরে জমা হওয়া কত খনিজসবই তো এই জলে এসে মিশেছে। পৃথিবীর, আল্পস্ পাহাড়ের জন্মের আগের, জন্মের পরের কত কথাখরস্রোতা নদীর নীল জলেসাদা ফেনাগুলোতে পাক খেয়ে বয়ে চলেছে। এমন নীল রঙ কখনোও দেখিনি এর আগে। দেখিনি মাথার উপরে নীল রঙা এমন আকাশও ! নৌকো এগোচ্ছে ফলস্ এর কাছে। বিরাট জলরাশি ধবধবে সাদা ফেনা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর নীল জলের বুকে আর সেই ধবধবে সাদা ফেনা জুড়ে রামধনুর সাতটি রঙ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! নৌকোয় বসে অনেকটা দূর থেকেই জলবিন্দু চোখে মুখে এসে লাগতে শুরু করেছে। নৌকো আরোও এগিয়ে চলেছে। জলের আওয়াজ, তার সঙ্গে নদীতে উথালপাথাল ঢেউ। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার! শুরুতে নৌকোতে স্বাভাবিক ভাবেই সকলে বসেছিলাম কিন্তু বিপুল জলরাশির কাছে গিয়ে আর এক জায়গায় বসে থাকা যাচ্ছে না। চালকের অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া জলরাশি খুব কাছে থেকে দেখবার সৌভাগ্য হল। শক্ত করে নৌকোর ধার ধরে বসে রয়েছি আমরা সকলে। জলের ঝাপটা এসে চোখে মুখে লাগল, লাগল মাথার চুলেওআমাদের সকলেরই ক্যামেরা, মোবাইল সব ব্যাগে তখন। শুধু দুচোখ ভরে প্রকৃতির এমন রূপ দেখে মন বিভোর হয়ে গেল।

 

পরবর্তী গন্তব্য জুরিখ লেক (lake) নীল কাঁচের মতো জলের বিশাল (১৮৬৯ স্কোঃ কিমি:) জুরিখ লেক। সুইৎজারল্যান্ডের সব নদী বা জলাশয়ে এমন নীল রঙের স্বচ্ছ জল। দেখলে মনে হয় নীল রঙ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে। জুরিখ লেক এর জলেও ধবধবে সাদা রাজহাঁসেরা মহা সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন ভারতীয় হয়ে বড় আশ্চর্য হলাম বিশাল জলরাশি পানযোগ্য বলে জেনে। লেকের ধার ঘেঁষে সার সার সাদা রঙের প্রাসাদোপম বাড়ি। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ট্রামলাইন। সুন্দর ছিমছাম দেখতে সাদা আকাশী নীল রঙের ট্রাম চলছে। ম্যাপল, ওক গাছ রাস্তার ধারে ধারে লাগানো। এমন সব গাছ দিয়ে ঘেরা শহরের মাঝখানে একটি জায়গায় skating shoe পরা ছোট থেকে বড় পুরুষ মহিলাদের ballet প্রতিযোগিতা চলছে। জায়গাটি ঘিরে দর্শকদের আসন। গান চলছিল। ভাষা না বুঝলেও ভালো লাগল। জুরিখ খুব সুন্দর আর খুব পরিচ্ছন্ন শহর। কিছুক্ষণ হেঁটে ঘুরে নিয়ে আবার বাসে চড়ে বসলাম।

জুরিখ লেক এ

জুরিখ লেক

জুরিখ থেকে এঞ্জেলবার্গের রাস্তা ধরতেই প্রকৃতি অপরূপ রূপে দেখা দিলেন। একের পর এক tunnel পেরিয়ে বাস ছুটে চলেছে। Tunnel বাইরের রাস্তার দুই পাশে পাহাড়ের ঢাল কি অদ্ভুত সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া! পাহাড়ের মাথায় ঘন সবুজ গাছপালার সারি। ওক, বার্চ, ম্যাপল, চেস্টনাট , পপলার গাছ এই অঞ্চলে দেখা যায়। চোখের পলক ফেলতেও ইচ্ছে করছিল না এমন সবুজ রঙ দেখে। এই সবুজের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে দুই পাড় বাঁধানো নদী অথবা খাল। আমার দেখা ইওরোপের শহরগুলির বাইরে সব জায়গাতেই এমন খাল দেখতে পেলাম। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার হয় এইসব খালের জল এবং সবই পানের যোগ্য নয়নাভিরাম সবুজের মধ্যে মধ্যে ঢালু চালের কাঠের দোতলা বাড়ি। উপরের ছাদের অংশ বাড়ানো থাকে এই দোতলা বাড়িগুলোতে সুইস আল্পসে এই বাড়িগুলিকে chalet বা শ্যালে বলা হয়। এইসব অঞ্চলে শীতকালে পুরু হয়ে কয়েকমাস ধরে বরফ জমে থাকে। বরফ আর বরফগলা জল থেকে বাড়িকে রক্ষা করে এই ঢালু ছাদ। আমাদের দেশেও পার্বত্য অঞ্চলে এমন ধরণের  বাড়িই দেখা যায় একই কারণে রঙীন ফুলের গাছ সব বাড়িতেই। শ্যালেগুলির সীমানা কাঠ দিয়ে তৈরী। বাড়ির মধ্যে মোটাসোটা, গোলগাল ভেড়াদের দেখা যাচ্ছিল। কখনও কখনও দেখা গেল ছোট্ট গীর্জাচ্যাপেল। জনসংখ্যা কম। জনবসতি কম। প্রকৃতির অকৃপণ হাতের পরশ এদেশে সর্বত্রই

 

সবুজ পাহাড়ের ঢালে গীর্জা

শ্যালে

ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে সাতটা প্রায় বাজছে। নামেই রাত। সূর্য তখনও আকাশেই। এসে পৌঁছলাম এঞ্জেলবার্গ – 'দেবদূতের পাহাড়ে' হালকা ঠাণ্ডা, আরামদায়ক বেশ। সাধারণ পোশাকেই রয়েছি সকলে। কাঁধের ব্যাগে আছে সোয়েটার, স্যুটকেসে আছে গরম জ্যাকেট। সামনের উঁচু পাহাড়ের ঢালে আমাদের হোটেলট্যুর ম্যানেজারের কথা অনুযায়ী আমরা বিশেষ ধরণের একটি হোটেলে এসে পৌঁছেছি।  হ্যাঁ, বিশেষই বটে। দুখানা tunnel পার হয়ে, দুখানা lift চড়ে গিয়ে হোটেলের lounge পৌঁছনর পর আবার lift চড়ে যার যার ঘরে।

এঞ্জেলবার্গে সন্ধ্যা নাম্বার ঠিক আগে


বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছে। বড় বড় ট্রলি রাখা আছে প্রথম tunnel সামনে। এক এক পরিবারের এক একটি ট্রলিতে জিনিসপত্র নিয়ে tunnel পেরিয়ে lift – আবার দ্বিতীয় tunnel সকলে দৌড়চ্ছি – lift সামনে প্রচুর ভীড়। সকলেই ভারতীয়। অন্য একটি গ্রুপও এসে পৌঁছেছে। আমাদের মধ্যে থেকে কেউ জানতে চাইলেন ওঁদের প্যাকেজ কত করে, কি পাচ্ছেন তাঁরা ইত্যাদি। বুঝলাম না জেনে কি হবে এমন সময়ে।

 

শেষমেশ গিয়ে পৌঁছলাম lounge এ। আমাদের দলের সকলেরই এমন দু খানা সুরঙ্গ পার করা হোটেলের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এরপর জানা গেল হোটেলের ঘর সব কাঠের। চলাফেরায় বেশী আওয়াজ হলে নাকি খুব বদনাম হয়ে যাবে। একটু ঘাবড়ে গেলাম। দেহের ওজন তো নেহাৎ মন্দ নয়। ওদিকে রাতের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। তো ভারতবর্ষ নয়। Dining Hall একটু দেরী হলে আর ঢোকা যাবে না। সুতরাং, সকলেই দৌড়, দৌড় আর দৌড়। হল জুড়ে আমিষ নিরামিষ ভারতীয় খাবারের যেন মেলা বসেছে। স্যালাডের রকমারি দেখবার মতোই ছিল।

 

রাতে ঘরে গিয়ে পা টিপে টিপে চলছি। বদনামের ভয়। নীচের ঘরে কোন্ দেশের লোক আছেনমোটেই চাই না ভারতীয়দের বদনাম হোক। ক্লান্ত শরীর। অধৈর্য্য হয়ে পড়ছি তখন। ঘরটি কিন্তু খুব সুন্দর। বড় ঘর ধবধবে সাদা বিছানা। একদিকে দুটি দরজা সঙ্গে দুটি বারান্দা। দরজা দুটি কাঁচের। বাইরে রাতের অপূর্ব দৃশ্য। পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটি। চোখ ঝলসানো নয়, বিন্দু বিন্দু আলোয় ঢালু উপত্যকা আলোকিত। বারান্দায় চেয়ার দেওয়াই ছিল। গিয়ে বসলাম। সামনে আল্পস্ পর্বত বেয়ে হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে চোখ মুখ জুড়িয়ে দিয়ে গেল। কি শান্ত, সুন্দর পরিবেশ। অনেকটা নীচে ট্রেন চলছে দেখা গেল। আকাশে তারার মেলা। পরিবেশ এত পরিচ্ছন্ন যে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সব কিছু। টুং টুং করে কোথা থেকে গরুর গলার ঘন্টার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দেবদূতেরা কি এমন সময়েই পাহাড়ে আসেন? নেশাচ্ছন্ন হয়ে বিছানায় গেলাম।

 

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙল বড় সুন্দর এক ঘন্টাধ্বনিতে। কাছেই আছে একটি abbey. পাহাড় ঘেরা এই শান্ত প্রকৃতির বুকে সেই ঘন্টার ধ্বনি কি যে অপূর্ব প্রশান্তির আবহাওয়া তৈরী করেছিলতা শুধু অনুভবের। বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আবছা অন্ধকার তখনও। লাল,সাদা রঙের ট্রেন চলছে এতটা উচ্চতা থেকে খেলনা রেলগাড়ি বলে মনে হচ্ছে। হোটেল থেকে হাঁটাপথে ছবির মতো ছোট্ট এঞ্জেলবার্গ স্টেশন। বারান্দা থেকে এক ধারে দেখা পাওয়া গেল cable car – Mt. Titlis যাওয়ার জন্য।

 

জলখাবার সেরে সেই দু খানা করে tunnel আর lift পার হয়ে নেমে এসে বাসে উঠলাম। গন্তব্য Jungfraujoch. সকলের সঙ্গেই গরম পোশাকের ব্যাগ। বাস চলতে শুরু করল রোদ ঝলমল করছে। কি অপরূপ সৌন্দর্য্য প্রকৃতিরভাষা দিয়ে প্রকাশ করা কঠিন। কারোও মুখেই কোনোও কথা নেই। সকলে এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য উপভোগে বিভোর। ফটো তোলা হচ্ছে চলন্ত বাস থেকেই।

 

বাস এসে থামল অদ্ভুত নীলাভ Lake Lungern ধারে। South Korean web series ' Crash landing on you' শ্যুটিং হয়েছে এই lake ধারে বলে জানা গেল। জলের রঙ দেখে সকলেই অবাক। এমন সৌন্দর্য্যকে মনের ক্যামেরা যান্ত্রিক ক্যামেরায় ধরে রাখার চেষ্টা করা হল।

Lake Lungern

আমাদের নিয়ে বাস গিয়ে পৌঁছল Grindelwald terminal এ। সেখান থেকে gondola চড়ে Eigergletscher হয়ে ট্রেনে চড়ে পৌঁছব Europe - সর্বোচ্চ রেল স্টেশন – Jungfraujoch এ। Eigergletscher পৌঁছে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। গরম পোশাক পরে নিলাম। মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি। Glacier এলাকা বলে কথা! সেখানে আবার ট্রেন লাইন! চারপাশ কাচ দিয়ে ঢাকা। বাইরে নীল আকাশের কোলে তুষার ধবল Eigergletscher বা Eiger glacier দেখা যাচ্ছে। আমাদের ট্রেন এসে গেল। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলাম। ট্রেন কিন্তু চলল সুরঙ্গ পথে। বাইরের কিছুই দেখা গেল না।

 

Jungfrau – Top of Europe
Alpine Chough, Jungfraujoch













আধ ঘন্টার মধ্যে এসে পৌছলাম খোলা আকাশের নীচে, বরফের রাজ্যে – Jungfraujoch – জার্মান শব্দটির অর্থ ' maiden saddle'. Top of the Europe Jungfraujoch station টি সর্বোচ্চ স্টেশন। এর উচ্চতা ৩৪৫৪ মিঃ(১১, ৩০০ ফুট)

পৌঁছনোর ঠিক আগে ট্রেন একটি স্টেশনে পাঁচ মিনিটের জন্য থেমেছিল। একটি কাঁচ মোড়া হলঘর থেকে Aletsch Glacier কে চোখে দেখবার জন্য। Jungfraujoch স্টেশনটি থেকে সুরঙ্গ পার করে একটি বহুতল বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম। জানলাম, বাড়িটির মধ্যেই যত কিছু ট্যুর ম্যানেজার সকলকে বাড়িটির ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটি বড় ঘড়ির ( হাওড়া স্টেশনের কথা মনে হয়েছিল, যদিও অমন ঘড়ি নয়) সামনে আমাদের সবকিছু দেখে ফিরে আসতে বলে দিলেন। হাতে দু ঘন্টা সময়।

Lift বা elevator ব্যবহার করে সবকটি দ্রষ্টব্য দেখবার জন্য ভালো করে দিক নির্দেশ করা আছে। সেই অনুযায়ী আমরা এগিয়ে পড়লাম।

 




আল্পসের নানা রূপ

সুইৎজারল্যান্ডের এই অংশ থেকে আল্পস্ পর্বতের বিখ্যাত তিনটি শৃঙ্গ দেখা যায় – Eiger, Jungfrau আর Monch. Monch আর Jungfrau শৃঙ্গের মাঝামাঝি সবথেকে নীচু জায়গাটি হল Jungfraujoch – এটি একটি glacier saddle সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে। Glacier দেখবার ইচ্ছেয় একদম উপরতলায় গিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে পা রাখলাম বরফে। চারিদিক সাদা ধবধবে বরফে ঢাকা। রোদ ঝলমলে দিন। আল্পস পর্বতমালার অপরূপ দৃশ্য। Jungfrau শৃঙ্গটি দেখা যাচ্ছে। এটি একটি জলবিভাজিকা। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মাথায় টুপি দিতেই হল। পৌঁছলাম Sphinx Terrace এ। ৩৫৭১ মি উচ্চতায় একটি ভিউ পয়েন্ট। বরফের উপর দাঁড়ানোর জন্য নিরাপদ, সুন্দর ব্যবস্থা। চারিদিক সাদা। দেখা যাচ্ছে Aletsch glacier .এই বরফের রাজ্যে দেখা পেলাম কালো রঙের হালকা হলদে ঠোঁটের পাখি – Alpine chough – আল্পস্ এর কাকমানে, কাক পরিবারের। সারাবছর বরফের রাজ্যে বাস করলে কি হবে? এত মানুষ জনকে তারা মোটেই ভয় পায় না। দিব্যি নির্ভয়ে ডাকাডাকি করছে। এক অন্য পৃথিবীর বুকে তখন আমরা। কিছু ফটো তুলে নেমে এলাম নীচে। একটি সুরঙ্গ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম Aletsch glacier বুকের উপর। ঠাণ্ডা তো আছেই , সঙ্গে উত্তেজনাওথরথর করে কাঁপছি। আল্পসের দীর্ঘতম, সবথেকে বড় হিমবাহ উপর দাঁড়িয়ে আমি! পা পিছলে যাচ্ছে। সামলিয়ে নিয়ে কিছুটা এগোলাম। উষ্ণায়নের ফলে দ্রুত গলছে পৃথিবীর সকল হিমবাহ ই। Aletsch glacier ও।

এরপর আমরা গেলাম Ice cave দেখতে। গুহাটির তাপমাত্রা -° সে. এই বরফের সাম্রাজ্যের একটি অংশে তৈরী বরফের গুহা।


আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা ছিল এই বরফের সাম্রাজ্যেই। বাড়িটির একটি অংশে হোটেলে সকলে মিলে জড়ো হলাম। খাওয়া সেরে স্যুভেনির শপ, চকোলেট শপ ঘুরে সেই বড় ঘড়ির সামনে সকলের দেখা হল। এবার ফিরে যাওয়ার পালা।

 

হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিজেদের ইচ্ছায় পায়ে হেঁটে এঞ্জেলবার্গ ঘুরতে বেরোলাম। ছোট্ট শহর। লোকজন বিশেষ দেখাই যায় না। মুখোমুখি যে কয়েকজন কে দেখলাম সকলেই বেশ শান্ত মনে মুখে আলগা হাসি নিয়ে চলেছেন। একটু দূরেই একটি ক্যানাল বয়ে চলেছে। তার উপর একখানা ভারী সুন্দর কাঠের ব্রীজ। সেটি পার হয়ে রাস্তা ধরে এগোলাম। সবুজ আর সবুজ শুধু। রাস্তার ধার থেকে ঢালু হয়ে পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত সবুজ। ঢালে গরু, ভেড়ার দল। ওদের গলায় বাঁধা টুং টাং শব্দ এমন নির্জন পরিবেশে কি যেন এক জাদু পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় ঝোপে হালকা বেগুনি ফুলে ভরে আছে। চেনা মিষ্টি গন্ধল্যাভেন্ডার ফুল। ক্যানালের পাশ দিয়ে হেঁটে পৌঁছলাম একটি জলাশয়ের পাশেযেটি বারেবারে আসা যাওয়ার সময় নজর কেড়েছিল ! পাহাড় বেয়ে জল নেমে জমা হচ্ছে সেই জল বয়ে চলেছে ক্যানাল দিয়ে দূর দূরান্তে। জলাশয়ের ধারে পাতা বেঞ্চে গিয়ে বেশ কিছু সময় কাটালাম। সূর্যাস্তের রঙ ধরছে পাহাড়ের গায়ে তখন। অদ্ভুত লালচে রঙ রুক্ষ এক পাহাড়ের গায়ে। মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল এত সব রঙের বাহারে।

এঞ্জেলবার্গের রাস্তায়, এক বিকেলে
এঞ্জেলবার্গে এক বিকেলে
 


এঞ্জেলবার্গে র রাস্তায়


পরদিন সকালে গন্তব্য Mt. Titlis. প্রথমে Cable Car তারপর ROTAIR – revolving cable car পাহাড়ের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে বরফের দুনিয়ায় পৌঁছলাম। দূষণমুক্ত পৃথিবীর কি রূপ ! পাহাড়ের গা বেয়ে glacier – এত কাছ থেকে আমাদের দেশে দেখবার সুযোগ ঘটে নি। কারণ, দুর্গমতা। কোথাও বা রুক্ষ পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় জমা নীল জল – glacial lake. একটি অংশের রুক্ষ পাহাড়ে বেশ কয়েকটি arm chair – ভূগোলের ভাষায় Corrie বা Cirque একসময়ে অনেকের মতোই পড়েছিলাম। চোখে দেখে বেশ উত্তেজনা অনুভব করলাম।

 

                                                              

গণ্ডোলা থেকে  – গ্লেসিয়াল লেক, করি বা সার্ক, 

Aletsch Glacier


আগের দিনের মতো সেদিনও বরফের মাঝেই কাটল। একটি suspension bridge উপর দিয়ে cliff walk সুযোগ পাওয়া গেল। পায়ের নীচে শুধু বরফ আর বরফে ঢাকা পাহাড়। বরফের চত্বরের একটি অংশে বসবার জায়গা। কফি, আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। দু খানা টেলিস্কোপ দুদিকে। Mt Titlis থেকে ফিরতি পথে আমাদের lunch break হল Trubsee lake ধারের রেস্তোরাঁতে। এটি একটি alpine lake – বরফের দ্বারা কোনোওভাবে সৃষ্ট হয়েছিল। একটি ভূ- গর্ভস্থ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এই অঞ্চলেই রয়েছে, যেখানে Trubsee lake জল ব্যবহৃত হয়।


Lake Trubsee


                                            পাহাড়ের উপর সূর্যাস্তের রঙ এবং এঞ্জেলবার্গ ক্যানাল

হোটেলে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে আবারও এসে বসলাম বারান্দায়। হাতে আর সময় বেশী নেই। শুধু এই রাতটুকু ছাড়া।

পরদিন এঞ্জেল বার্গ ছেড়ে চলে যেতে হবে। সকলের মন খারাপ হয়ে আছে। এত সুন্দর, শান্ত , দূষণমুক্ত প্রকৃতির কোলে আশ্রয় পেয়ে বড় ভালো লেগেছিল। সকাল হতেই তৈরী হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। সামনের পাহাড়গুলো, ঝরঝর শব্দে বয়ে যাওয়া ক্যানাল, সুনীল আকাশ, abbey থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি, অনেক নীচে খেলনার মতো লাগা লাল- সাদা ট্রেন অথবা Mt. Titlis যাওয়ার cable car – সবকিছুর সঙ্গে মন মায়ায় যেন জড়িয়ে ফেলেছে। এঞ্জেলবার্গ বা "দেবদূতের পাহাড়"– নামটি সার্থক। মন খারাপ হলেও বেরোতেই হল আগামী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

 

সুখস্মৃতি বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মন খারাপ হয় একজন ভারতবাসী হিসাবে। প্রকৃতির অকৃপণ দানে ভারতবর্ষও ধন্য। বিপুল জনসংখ্যা, যোগ্য শিক্ষার অভাবে আমরা নিজেদের সুমহান ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি। প্লাস্টিকের ব্যবহার এখন সর্বত্র নিষিদ্ধ। যেখানে পৃথিবীর এই উন্নত দেশের সাধারণ মানুষেরা পৃথিবীকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে, পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে পরম যত্নে চেষ্টা করে চলেছেনসেখানে আমরা কবে শিখব? কখনোও কি শিখতে পারব?

এর উত্তর জানা নেই।

*সব ছবি লেখকের নিজস্ব 
*ছাত্রী, ১৯৮৯

মন্তব্যসমূহ

  1. বাহ্ , খুব ভালো ঘুরলে , দারুণ সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন জায়গা , সত্যি আজকাল নিজেদের দেশের জন্য কষ্টই হয় ....

    উত্তরমুছুন
  2. মৌসুমী তুই এতো সুন্দর করে লিখেছিস মনে হচ্ছে যেন আমি স্ব চক্ষে দেখছি। যেমন সুন্দর বর্ণনা তেমন সুন্দর ছবি। বেশ ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  3. অপরিসীম ভালোলাগায় মন ভরে গেল। Abbey র ঘন্টাধ্বনী যেন শুনতে পেলাম। নীলে-সবুজে জড়িয়ে গেল মন প্রাণ 🩵

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

সময়