মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি

 সুদেষ্ণা দে


প্রিয় দিদি আর বোনেরা,

সবাই ভালো আছো/আছেন নিশ্চয়ই। 

আজকের গল্প একটা ছোট্ট গ্রাম নিয়ে। শুরু করি,

উত্তর সিকিম এর মঙ্গন সাব-ডিভিশন এর মধ্যে একটা গ্রাম হলো Dzongu. এই জায়গায় আসলে একটা ফরেস্ট ব্লক। মঙ্গন থেকে মানতাম সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে Dzongu ওঠার রাস্তা। বর্ধিষ্ণু একটা সুন্দর গ্রাম। ততোধিক সুন্দর এর প্রাকৃতিক দৃশ্য। 

আমরা সকাল 8.30টায় শিলিগুড়ি থেকে শুরু করে মঙ্গন পৌছালাম প্রায় 5টা। আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি পড়ছে। আমি তার মধ্যে একটা পাতলা tshirt গায়ে। ঠাণ্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়ছে যত সময় এগোচ্ছে। খিদেতে পেট চুঁই চুঁই। তার মধ্যে পারমিট এর জন্য এই দোকান ওই দোকান ঘুরছি। একটা খাবারের দোকান খোলা নেই একটা মিষ্টির দোকান বাদে। দুপুরের Maggi আর চা কবেই হজম হয়ে গেছে। তার মধ্যে খবর পেলাম আমাদের প্রায় 1.30ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে পারমিট এর জন্য। মাথায় হাত। তার মধ্যে তেড়ে বৃষ্টি শুরু হলো। ঠাণ্ডা খিদে সব মিলিয়ে একাকার অবস্থা। মঙ্গন এর নিচের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। একটা টয়লেট নেই। সব বন্ধ। কারণ সেদিন দসেরা। এদিকে এককাপ চা পেলে জীবনটা বেঁচে যায় এই রকম অবস্থা। সেই নিচের রাস্তায় দেখি একটা পুজো হচ্ছে। মা দুর্গা স্বপরিবারে বসে আছে আলো হয়ে। সবাই মিলে মজা হচ্ছে ঢাক বাজছে। তখন সন্ধ্যে শেষের মুখে। আকাশের একটা কেমন নীলচে ঘোলাটে রঙ। রাস্তায় আলোর মেলা। একটা Labrador আমাদের সঙ্গ নিল। বাচ্চাটার চোখে আবার ঠাণ্ডা লেগেছে। 


মঙ্গন এর বাজার। শেষ বিকেল দূর্গা মায়ের পুজো আর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি

এই সব পেরিয়ে হটাৎ নাকে এলো টাটকা খাবারের গন্ধ। দেখি কত গুলো বাচ্চা ছেলে এক বিশাল গামলা থেকে খিচুড়ি দিচ্ছে।

এক পাতা সব সবজি পনীর দেওয়া পাতলা ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। ওপর দিয়ে পাতলা টক আচার। 

অপূর্ব শব্দটা সেদিন কিঞ্চিৎ কম পড়েছিল। আমি কোনোদিন এই খাবারের স্বাদ আর পরিবেশটা ভুলবো না। বেঁচে গিয়েছিলাম। বলে যে খিদের মুখে খাবারের স্বাদ তার কোনো তুলনা নেই। 

এরপর পারমিট করিয়ে যাত্রা শুরু করলাম আবার বৃষ্টি আর ঘন অন্ধকারকে সঙ্গী করে। পাশ দিয়ে প্রবল গর্জন করে তিস্তা বয়ে চলেছে। এই ছোট্ট ব্রিজটা ঐখানেই দেখতে পাই। শুধু ওই টুকুই আলো বাকিটা অন্ধকার। 

তখন জানিনা রাস্তা বলে আদৌ কিছু আছে কিনা।

আবার শুরু, এরপর একটা জায়গা এলো ঝর্না পড়ছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বুঝলাম ঝর্না সামনে। তলা দিয়ে না গিয়ে একটু পাশ এর দিকে যেতেই পিছনদিক থেকে homestay মালিকের হর্ন। দৌড়ে এলেন সামনে। বলা হয়নি যে ওনারা রাস্তার ভয়ঙ্কর অবস্থা বিচার করে মঙ্গন এসেছিলেন আমাদের জন্য। আর একটু ওদিক হলেই সোজা খাদে। একটু থেমে ধীরে ধীরে ঝর্নার প্রায় তলা দিয়েই আবার ওঠা শুরু। ততক্ষণে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। আরো প্রায় কিছুক্ষন পর এসে পৌঁছলাম homestay তে। রাত অনেক। ঘরে পৌঁছে বিছানায় যখন বসলাম মনে হচ্ছিল যুদ্ধ জয় করে এলাম। এরপর পেট আবার ডাক দিয়েছে। খেতে ডাকতে এলেন আমাদের। ঘরে নয় কিচেন এর সাথে লাগোয়া ঘরে বসার ব্যবস্থা। এরপর সেই অপূর্ব খাবার। ডাল, ভাত, ঢেঁড়স ভাজা (অমন মুচমুচে ভাজা আমি কোনোদিন খাইনি), সবজি, আর চিকেন। যে মেয়ে চিকেন শুঁকে খায় সেও তখন হামলে পড়েছে। সাথে বিশেষ চাটনি বা আচার। কত যে খেয়েছি সেদিন। কলকাতায় মেপে এক কাপ ভাত খাই সেখানে তো থাক। খেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। কেউ যদি একটু তুলে দিত বেশ ভালো হতো। যাক। খেয়ে যখন বসলাম এক আকাশ মেঘ সাথে নিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে গেলো এক মিনিটে। 

মনে প্রশ্ন পাহাড় দেখার চান্স নেই

মনে মনে সেট করে বসেছি ভোর .৩০তে উঠবো। সেই মত রাতের গল্প সেরে শুয়ে পড়লাম। 

আমার অ্যালার্ম বাজছে। বন্ধুরা যাচ্ছেতাই বলতে শুরু করেছে। ধুর তোদের দ্বারা হবে না। একাই কাঁচের জানলার পর্দা সরিয়েই হতবাক। গাঢ় নীল রঙের পাহাড় আর সাথে হালকা নীল রঙের আকাশ। বৃষ্টি হয়েছে সারারাত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু একটু পরেই মেঘ এসে ঢেকে দিল সব। 


ভোর প্রায় 5 টা

সেদিনের ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোলাম কিছু দেখতে। উষ্ণ প্রস্রবণ এর রাস্তায় ধ্বস সেই রাস্তায় আমাদের গাড়ি উঠবে না। কাজেই ৪মিল এর কাছে দাঁড়িয়ে গেলাম। নদীর উত্তাল স্রোত। উপর থেকে ধ্বস নেমে সব নিয়ে ভেসে গেছে। জীবন কঠিন। 

4মিল এর সেই জায়গাটা


খেলা দেখতে যাওয়ার পথে বৌদ্ধ স্তুপ

ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে উপরের স্কুল গেলাম ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখতে। মাথায় ছাতা, গরম চা আর পিঁয়াজি নিয়ে সবার সাথে সে এক হই হই কাণ্ড। ওরা খেলছে আমাদের তখন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল অবস্থা। Gooooooool ......

ভোরের আকাশ পরের দিন
একটু পরেই সব ঢেকে গেল মেঘে

পরদিন সকালের এক অবস্থা। সেদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করেছি। যাবো ঊষ্ণ প্রস্রবণ, মিউজিয়াম, আর মনাস্ট্রী। রাস্তা শুরু হলো। রাস্তা না বলে কোনো রকমের একটা কিছু বলাই ভালো। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হলো ওই রাস্তা দিয়েই সব গ্রামের মানুষেরা যাতায়াত করছেন একটুও বিরক্ত নেই। উষ্ণ প্রস্রবণ আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো। জায়গাটা ভক্তি হবে না শহুরে লোকেদের। কিন্তু আমাদের বেশ লাগলো। লোকাল নাগা মানুষেরা এসেছেন সেই কোন দুর থেকে। আমরাও মিশে গেলাম। গল্পে গল্পে তারা আপ্যায়ন করলেন লাঞ্চের জন্য। বাইরেই এক ফালি জায়গা। সেইখানেই তৃপ্তি করে খাওয়া হলো। ভালোবাসার আদান প্রদান হলো। কথা দিলাম যাবো বাড়ি। গেছিলাম ও। 

মাঝে একটা জায়গায় এলাম যেখানে একটা ঝুলন্ত সেতু। নদীর এপার থেকে ওপারে। একটানা বৃষ্টিতে নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠছে। খর বেগে বইছে। ব্রিজ পেরিয়ে নদীর পাশে কিছুক্ষনের বিরতি। অবিরাম হয়ে চলা নদীর পাশে কিছুক্ষণ যেনো পলক ফেলতে কেটে যায়। নদীর জলের আওয়াজ মনকে শান্ত করে। 

সেই ঝুলন্ত ব্রিজ

ব্রিজ এর ওপর থেকে উত্তাল নদী

ফিরে এসে গেলাম মনাস্ট্রীতে। শান্ত জায়গা। বসে সবাই প্রার্থনা করছে। আমরাও বসলাম। ভিতরটা খালি হয়ে গেলো। একফালি বারান্দা থেকে দূরের মেঘ গুলো দেখছি আনমনে। কেটে গেছে অনেক সময়। ফেরার পথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। চারদিক খালি বৃষ্টি শব্দ আর পাখির আওয়াজ। 

এই ভবেই আমাদের dzongu শেষ হলো। 

ওহ বিকেলের কথা বলিনি। বিকেলে অজস্র জোঁক এর ভয় উপেক্ষা করে ফিরে গ্রামটা পায়ে হাঁটা রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। চোখ আর মনের মাঝে ঘন সবুজের সমারোহ নিয়ে আমাদের মন তখন তৃপ্ত। আকাশ জুড়ে তখন তারা রাশি। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি। বৃষ্টি থেমেছে বিকেল থেকে। মনে আশা তখন ভোর বেলায় পাহাড় দেখতে পাবো। 


বিকেলে জোঁক উপেক্ষা করে গ্রামের পথে

অনুরোধ প্লাস্টিক আর নোংরা করে লোভ দিয়ে কোনো স্থানীয় জায়গাকে নষ্ট করবেন না। দায়িত্ব আমাদের সবার। ভালো থাকলে কাল ভালো থাকবে। যেখানে থাকবেন সেখান কার মত করে মানিয়ে নিন। 


সাম্মানিক, ২০০৯


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়