বাঙালি এবং রুশ সাহিত্য


 



শরণ্যা সরকার

আমরা বাঙালিরা,যাদের ছোট থেকে বড় হওয়ার পিছনে সাহিত্যের একটা বড় অবদান থাকে সকল বয়সের জন্যে, সকল ধরণের লেখার জন্যে রয়েছে বাংলার অফুরন্ত সাহিত্যসম্ভার আজ থেকে  চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে এই বাংলা সাহিত্যের জগতে এক ঘরানার লেখা প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো, বাংলায় অনুবাদ করা সোভিয়েত সাহিত্য

১৯৫০-৬০র দশকে বাংলায় গড়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রীয় প্রকাশন সমিতির বাংলা বিভাগযার নাম প্রগতি প্রকাশনী  পরবর্তীকালে সেই প্রগতি প্রকাশনীর হাত ধরেই বাংলায় খুলে যায় নতুন এক ভাষার সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার লিও তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে পুশকিন, আরকাদি গায়দার, আন্তন চেখভ, ছোটদের রূপকথার গল্প থেকে শুরু করে রাজনৈতিক আদর্শমূলক  বই বাঙালিদের হাতে পৌঁছে দেয় তখনকার কিছু প্রকাশনী - ভস্তক, প্রগতি , রাদুগা  এবং মির

আশির দশকে বাংলায় ছোটদের সাহিত্য রাদুগা এবং ভস্তকের হাত ধরে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়  সেই সময়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে সেই সব বই গুলোযার মধ্যে 'রুশদেশের উপকথা', 'ইউক্রেনের উপকথা', 'কাশতানকা', 'সার্কাসের ছেলে', 'ককেশাস এর বন্দী' এবং আরো অনেক বই উল্লেখযোগ্য তখন বইমেলা মানেই ছিল ভস্তকের স্টল, আর তাতে উপচে পড়া শিশু সাহিত্যের বই,  'উভচর মানুষ', 'সিভকা-বুরকার ঘোড়া', 'দুই ইয়ারের যতো কান্ড', যা আজও অনেক বাড়িতে পুরনো বইয়ের তাকে  পাওয়া যাবে

সেই সব ছোটদের রঙচঙে বইগুলোর ছবি ছিল অনবদ্য ধবধবে সাদা নরম তুষার মোড়া পটভূমিতে অদ্ভূত সুন্দর পোশাক পরা মানুষ গুলোর গল্প চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতো এত সুন্দর ছিল সে গল্পকথন এবং অনুবাদ, ছোটদের মনে রুশদেশ নামক একটি স্বপ্নরাজ্য গড়ে তুলেছিল

শুধু শিশু সাহিত্য নয়, প্রগতি প্রকাশনীর হাত ধরে নানারকমের রাজনৈতিক মতাদর্শের বই মানুষের কাছে পৌঁছে যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন'

বই এর পাশাপাশি 'সোভিয়েত নারী', 'সোভিয়েত দেশ' এর মতো নানারকম ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো চকচকে সেই বইয়ের পাতার পর পাতা জুড়ে থাকতো নানা রকমের প্রবন্ধ, এবং চোখ ধাঁধানো ছবি

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক এক করে বন্ধ হয়ে যায় সেই সব প্রকাশনা  সেই থেকে আর প্রকাশ পায়নি নতুন কোনো বই

সেই ষাট বা সত্তরের দশকে না জন্মালেও সৌভাগ্যক্রমে আমার পুরো ছোটবেলা কেটেছে সেইসব বই পড়ে একরকম সোভিয়েত বইগুলির জন্যেই আমি বাংলা পড়তে শিখেছি  পরে আমার সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছিঅনেকেই রসে বঞ্চিত

পুরোনো বইয়ের দোকানে, কলেজ স্ট্রিটে খুঁজে দেখেছি সেইসব সোভিয়েত বই গুলো, পেয়েওছি কয়েকটা, ভিতরে জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা লেখা, বাঁধানো বইপ্রত্যেকটি হলদে হয়ে যাওয়া পাতার সাথে লেগে আছে আমারই মতো আরেকজনের ছোটবেলা

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই সোভিয়েতকেই মনে রাখতে চাই, সেই ছোটবেলায় পড়া কল্পনার সোভিয়েতসেই নরম বরফ মোড়া দেশ, যেখানে গমের খেতে সূর্যের রোদ পড়লে খুদেরা তাদের পোষ্যদের নিয়ে খেলে বেড়াতো, আর বাড়ির মেয়েরা ঝুড়ি নিয়ে জঙ্গলে ব্যাঙের ছাতা কুড়োতে যেতো

সে এক হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের দেশ


*ছাত্রী, সাম্মানিক তৃতীয় অর্ধবর্ষ 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়