বিনু মা

 

দেবস্মিতা সরকার






বিনোদিনী দেবীর বয়স প্রায় পচাত্তর বৃদ্ধ বয়সেও বেশ প্রাণোচ্ছল তিনি নিজের প্রতি যত্ন নিয়ম করে চলার ফলে কোনো রোগ বিশেষ তাকে কাবু করতে পারেনি এখনো নিজের যাবতীয় সাংসারিক কাজ থেকে শুরু করে সংসার বহির্ভূত কাজ একা হাতে সামলে চলেছেন সেই জোয়ান বয়সের মতোই চাইলে যে একজন সর্বক্ষণের দেখভালের লোক তিনি রাখতে পারতেন না তা নয়, তবে বিনোদিনী দেবীর মতে, 'যতদিন এই ভগবানের দেওয়া হাত আর পা জোড়াতে বল রয়েছে ততদিন এক গ্লাস জলও বাপু কাউকে গড়িয়ে দিতে হবে নি' বেশ আমুদে মহিলা দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে একা থাকেন বটে তবে মিশুকে মিষ্টিভাষী হওয়ায় পাড়ায় প্রায় সকলে দু'বেলা এসে গল্প গুজব করে যায় এক কালে কলকাতার নামজাদা একটি কলেজে প্রফেসরও ছিলেন বলে সম্মানও করেন বহু লোক সবটা মিলিয়ে দিব্বি কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো বিনোদিনী দেবীর

তবে দিনের শেষে কোথাও গিয়ে একাকীত্ব গ্রাস করে সারাদিনের এই প্রাণোচ্ছল ভদ্রমহিলাকে অর্ধ্যেন্দু, বিনোদিনী দেবীর একমাত্র পুত্র, চাকরির সূত্রে থাকে সুদূর USA তে বছরে দুটো দিন ছেলে মা কে ফোন করে, এক নববর্ষ আর দুই বিজয়া দশমী আর বিনোদিনী দেবীর ফোন ছেলে ওঠানোর বিশেষ একটা প্রয়োজন মনে করেন না আর যদিও বা রিসিভ করে  'ভালো আছি, কনফারেন্স রুমে রয়েছি পরে কথা বলবো' বলেই নামিয়ে রাখে কচিৎ কব্যে এই ফোনে ছেলের গলা শুনেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একাকীত্বকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন বৃদ্ধা

তো গেল সাংসারিক বিনোদিনী দেবীর কথা - কাহিনী এই সংসারের বাইরেও বিনোদিনী দেবীর আর এক সংসার ছিল এক কালে শিক্ষকতার সাথে সাথে তিনি দশটি ছেলে মেয়ে নিয়ে চালাতেন "গীতবিতান" নামের আবাসন বলা বাহুল্য, তিনি শুধু অর্ধ্যেন্দুর মা ছিলেন না, ছিলেন ওই আবাসনে থাকা ফুটপাথ থেকে তুলে এনে স্বস্নেহে নতুন জীবন দিয়ে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা বহু ছেলে মেয়ের বিনু মা সবই সুখী গৃহীকণের ন্যায় নিপুণ হাতে সামলেছেন বিনোদিনী দেবী এর মাঝেই ছেলের স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ যাত্রা এবং বিনোদিনী দেবীর স্বামীর মৃত্যু আর সেই থেকেই বিনোদিনী নামক সুখী গৃহীকোণের একা পথচলা বিনু মায়ের চলার পথে সঙ্গেই ছিল তার দশ সন্তান, কিন্তু অর্ধ্যেন্দুর মায়ের ছিল কেবল প্রতীক্ষা। 

বিনু মায়ের সেই ছেলেমেয়েরা এখন বড় হয়েছে, নিজেদের জীবনে তারা প্রতিষ্ঠিত তবে নিয়মিত কেউ না কেউ বিনু মায়ের খোঁজ নিতে আসবেই আসবে বিনু মা ছাড়া যে কেউ অফিস ফিরতি মানুষ গুলোর জন্যে লুচি, হালুয়া বানিয়ে রাখবেনা একটা হেক্টিক ডে - এর পরে কোলে মাথা রেখে শুইয়ে চুলে বিলি কেটে দেবেনা। 

দেখতে দেখতে আবার বাঙালির তেরো পার্বণ - এর শ্রেষ্ঠ পার্বণ দুর্গা পুজো চলে এলো শহর আলোয় ঝকমক করছে পুজোর চারটে দিন বিনোদিনী দেবীর মন্দ কাটেনা বিনু মায়ের ছেলে মেয়েরা রোজ একবার করে এসে সান্ধ্যকালীন গল্পে, হাসি মজায় মাতিয়ে দিয়ে যায় বাড়িটাকে দেখতে দেখতে দশমী এসে গেলো সকাল থেকেই বিনোদিনী দেবীর মনটা আজ খুশি খুশি আজ যে তার অনুর ফোন করার দিন সেই বৈশাখে নববর্ষে ফোন করেছে, তার পরের এই কয়েকটা মাস ছেলে ব্যস্ততায় মায়ের ফোন রিসিভ করেনি আজ কতদিন পরে আবার ছেলের গলাটা শুনবেন ভেবেই মনটা আপ্লুত বিনোদিনী দেবী বাস্তবে বিশ্বাসী, তাই তো এখন আর ছেলে মা কে দেখতে আসেনা বলে আফসোস করেন না ছেলের গলা শুনে শান্তি পাওয়াকেই বাস্তব বলে মেনে নিয়েছেন প্রতি ঘন্টার কাটা এগোয় আর বিনোদিনী দেবীর প্রতীক্ষার উত্তেজনা বেড়ে চলেছে ফোনটা তিনি আজ একবারের জন্যেও মুঠো ছাড়া করেননি পাছে ছেলের ফোন রিসিভ করতে দেরি না হয়ে যায় সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর নামলো সন্ধ্যে কিন্তু কই এখনও তো অনু ফোন করলনা! এদিকে পাড়ার মন্ডপের ঠাকুর বিসর্জনের যাত্রা করল দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় দাড়িয়ে বিনু মা একবার শেষ প্রণাম ঠুকল দুগ্গা মা কে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো তবুও অনুর ফোন ঢুকলো না বার বার ফোনটা খুলে কল লিস্ট চেক করতে থাকেন অর্ধ্যেন্দুর মা আজ সন্ধ্যেটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার বিনু মায়ের ছেলে মেয়েরা দশমীর সন্ধ্যায় আর বাড়ি আসেনা একেবারে একাদশীর দিন এসে বিনু মা কে বিজয়ার প্রণাম সেরে তার হাতের রান্না খেয়ে যায় কারণ তারা আজকের দিনটা অর্ধ্যেন্দু আর অর্ধ্যেন্দুর মায়ের জন্যে ছেড়ে দেয় পাছে তারা থাকলে বিনোদিনী দেবীর অর্ধ্যেন্দুর ফোন করার আনন্দতে বিনু মায়ের আগমন না ঘটে এই একটা দিনই তো নাড়ির টানে টান পড়ে বাকি দিন হাপিত্যেশ করাও যে বৃথা। 

শোবার ঘরের আরাম কেদারায় গা এলিয়ে অনুর অপেক্ষায় বসে বিনোদিনী দেবী শহর আজ একটু শান্ত মায়ের বিসর্জনের পর কয়েকদিনের ধকলে ক্লান্ত শহর ঝিমিয়ে রয়েছে ঝিমিয়ে রয়েছে মুহূর্ত গুলো সকালেই বিনু মা কে মিষ্টি মুখ করাতে হাজির তার বিনু মায়ের ছেলে মেয়েরা বার কয়েক বেল বাজানোর পরেও বিনু মা দরজা না খোলায় নিজেরাই লক খুলে ভেতরে ঢুকে আসে তারা এঘর সেঘর করতে করতে তারা বিনু মাকে আবিষ্কার করলো তার শোবার ঘরের আরাম কেদারায় চোখ জোড়া আধো বোজা দেখলে বোঝা যায় সারা রাত বারি ধারা ঝরেছে স্নেহমাখা দুই চোখ থেকে কাছে গিয়ে একবার গায়ে হাত দিয়ে থমকে যায় বিনু মায়ের ছেলে মেয়েরা হিমশীতল দেহ নিষ্প্রাণ বিনোদিনী দেবীর মুঠোয় তখনও ফোন খানা আগলে রাখা পাছে ছেলের ফোন রিসিভ করতে দেরি না হয়ে যায় ছেলে যে বড় ব্যস্ত হাত থেকে ফোনটা নিয়ে লক খুলতেই বিনু মায়ের ছেলে মেয়েদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো অর্ধ্যেন্দুর ফেসবুক প্রোফাইল তাতে বেশ কয়েকটি ছবির ওপর ক্যাপশন 'শিকাগোয় বিজয়া বৈঠক' বুঝতে বাকি রইলো না অনুর ফোন আসেনি অর্ধ্যেন্দুর মায়ের ফোনে সম্ভবত বিজয়ার বৈঠকের উল্লাসে মাকে বছরের দ্বিতীয় বারের ফোন করতেই ভুলে গেছে অর্ধ্যেন্দু বা হয়তো প্রয়োজন মনে করেনি

অন্তিম যাত্রায় বিনু মায়ের সঙ্গী হলো তার বরাবরের সঙ্গী দশ ছেলে মেয়ে পাড়াতেও শোনা গেলো বিনু মা আর নেই কারোর মুখে ভুলেও শোনা গেলো না " অর্ধ্যেন্দুর মা " বিনোদিনী দেবী  " বিনু মা" হয়ে রয়ে গেলেন চিরকালের জন্যে

*ছাত্রী, সাম্মানিক পঞ্চম অর্ধবর্ষ  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়