বৃষ্টির সঙ্গে মাডিকেরির রাতদিন

 মৌসুমী ব্যানার্জি


নানা জায়গায় বেড়ানোর শখ তো ছিলই এতকাল, ইদানীং তার সঙ্গে আরোও একটি শখ অথবা স্বপ্ন  আমার মনের সঙ্গী হয়েছে ।  বেড়ানোর জায়গাটি ভালো লেগে গেলে (সব জায়গাই ভালো লাগে) সেখানে সবুজ প্রকৃতির কোলে , জলের ধারে, অন্ধকার রাতে তারা ঝিকমিক করা কালো আকাশের নীচে একখানি ছোট্ট কুঁড়েঘরের শখ আমাকে পেয়ে বসছে। তা সে জায়গা জঙ্গল হোক,  মরুভূমির বালিয়াড়ি হোক, সমুদ্র সৈকত বা অত্যুচ্চ, শীতল  হিমালয়ই  হোক – নিরিবিলি সরল এক গ্ৰামের জীবন যেন হাতছানি দেয় আমাকে!  মজার কথা হল – নয় নয় করে কল্পনার জগতে   এমন ভালোলাগায় ঘেরা , মায়ায় ভরা বেশ কিছু ছোট্ট কুঁড়েঘরের মালিকও  আমি হয়ে গিয়েছি।  অলস দুপুরে বা মন খারাপের সময় হঠাৎ করে  কোনোও এক কুঁড়েঘরের দাওয়ায় মনে মনে গিয়ে বসে পড়তে মন্দ লাগে না।  মনের আনাচ কানাচের অন্ধকার কোণগুলো খুশীর আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। 

চলেছি মহীশূর থেকে কোডাগু বা কুর্গ জেলার  মাডিকেরির  পথে। সহ্যাদ্রি পূর্ব ঢালের একটি  শৈলশহর।  এসে অবধি  সবুজে ঢাকা পরিচ্ছন্ন শহর মহীশূর বা মইসুরু কে ভালোবেসে ফেলেছি। কালো কুচকুচে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে। হালকা ঠাণ্ডা, জলো শিরশিরে হাওয়া মুখে চোখে  সুখের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুধারে থেকে থেকেই চলেছে নারকেল গাছের বাগানের সারি। বর্ষার ছাইরঙা আকাশের পটভূমিতে বড় সুন্দর সে দৃশ্য! আমার সেই অদ্ভুত  ভালোলাগা – খালের ধারে  যেখানে নারকেল বাগানের সীমানা শেষে ধানক্ষেত শুরু হয়েছে সেখানে ঐ ছাইরঙা আকাশটার নীচে  একটা কুঁড়েঘর বানিয়েও ফেলল! 

গাড়ির চালকের নাম শ্রীনিবাস।  সপ্তাহে বেশ কয়েকবার কুর্গ থেকে মহীশূর যাতায়াত করতে অভ্যস্ত তিনি।  তাঁরই মুখে জেনেছিলাম  মাডিকেরির (কুর্গ বা কোডাগু জেলার উপকেন্দ্র) অলি গলি তাঁর চেনা। সেইজন্যই ভরসা করে  সারারাত বৃষ্টির পরেও আমরা কুর্গের পথে রওনা হয়েছি।  শ্রীনিবাসজী মাতৃভাষার বাইরে হিন্দীতেই একমাত্র স্বচ্ছন্দ, এবং তা আক্ষরিক অর্থেই।  বেশী প্রশ্ন করা তাঁর বড়ই অপছন্দ। তিনি  দ্রুতগতিতে  যা বলবেন তা মন দিয়ে শুনতেই হবে।  তা তুমি বোঝ আর নাই বোঝ।  তোমার উৎসাহ  নাই বা থাকল তাও মন দিয়ে শুনতে হবে। (যেমন রাস্তা দিয়ে ছাগলের দল চলছিল।  ছাগলের ব্যবসা খুব লাভজনক ইত্যাদি কি, কেন  পুরো সিলেবাস শেষ) আবার মাঝপথে থামিয়ে  'বুঝেছি' বলেই বিপদে পড়েছিলাম।  এমনিতেই  আমি  একখানি হাঁ করা মানুষ। যা দেখি, তাতেই হাঁ এর সাইজ   বড় থেকে আরোও বড় হয়ে যায়। সঙ্গে হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ভীড় করে আসে। এমনই এক প্রশ্নের উত্তরে  শ্রীনিবাসদা আমাকে নিয়ে বেজায় খেপে উঠেছিলেন (যদিও বুঝি নি কারণটা) বেশ অভিমান করে একবার বলেও ফেললেন, 'অম্মা, এ্যায়সে নঈ (নহী) পুছতা' – ।


এমন সবকিছু নিয়েই আমরা পৌঁছলাম 'ডুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প' এর উদ্দেশ্যে  কাবেরী নদীর ধারে।  ক্রমাগত বৃষ্টিতে   দু কূল ছাপিয়ে কাবেরীর  ঘোলা জল তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে।  অপর পারে  এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। স্পীড বোটে করে যেতে হবে।  ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে  স্পীড বোটে চেপে নদী পেরিয়ে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প এ পৌঁছলাম। কর্ণাটক বন দপ্তরের এক্তিয়ারে কাবেরী নদীর ধারে ডুবারে ফরেস্ট। পরিবেশ পর্যটনের কথা মাথায় রেখে কর্ণাটক সরকারের উদ্যোগে এই  ডুবারে রিজার্ভ ফরেস্টে বেশ কিছু হাতিকে যত্ন সহকারে প্রতিপালন করা হয়। হাতিদের  দেখাশোনা মাহুতরা করে থাকেন‌।  মহীশূরের 'দশেরা' উৎসবের দিন এই হাতিদের  সাজিয়ে রাজপথে বার করা হয়।  এমনিতে হাতি আমার বেশ পছন্দের।  হাতির চেহারা বিশাল ঠিকই কিন্তু বড় আদুরে চোখ মুখের ভাব ।  ঘুরে ঘুরে দেখলাম। মাহুতের কথামত তাদের  গায়েও হাত বুলালাম।  শুঁড়ে হাত দিতেই এম্ব্রয়ডারী সূঁচের মতো লোম হাতে বিঁধল। একজনের সঙ্গে ফটো তুলে খুশী মনে ফিরে এলাম নদী পার হয়ে। 




ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। দুপাশে ঘন বড় গাছের জঙ্গল আর মাঝখানে কালো পিচের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চলেছি। বেলা পড়ে আসছে। জঙ্গলে কত রকমের ফুল। চেনা নয় তেমন। গাড়ির গতি কোনোও কারণে কম হলেই শোনা যাচ্ছে  অদ্ভুত সব পোকার ডাক এই পড়ন্ত বেলায়।  এমন পাহাড়ি, জঙ্গলঘেরা পথে মেঘলা আকাশ, ঠাণ্ডা হাওয়া, বৃষ্টি ,  – বড় ভালো লাগছিল।মাঝেমাঝে বাগান ঘেরা কি সুন্দর টালির  দোতলা বাড়ি !  পথের কয়েকটা বাঁক পার হতেই জঙ্গলের চেহারার বদল হল। শ্রীনিবাসদা বললেন, কফি ট্রি দেখো অম্মা! রাস্তার দুধারে যতদূর দেখা যায় সবই 'কফি ট্রি'।  কিছু পরে  আমাদের  গন্তব্য  Mercara Gold Estate Coffee Plantation  এ এসে পৌঁছলাম।  ভালোই বৃষ্টি তখন। বিরাট গেট। টিকিট করা হল। গেটের ভিতর ঢুকে গাইডের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হল আমাদের।  বৃষ্টিভেজা নানারকমের গাছপালা – যার  প্রায় সবই অচেনা।  মাঝখান দিয়ে পিচ বাঁধানো  জলে ভেজা সরু রাস্তা।  বেশ ঠাণ্ডা লাগছে তখন।  ছাতা মাথায়  দিয়ে গাইডের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই  নজরে পড়ল কালচে সবুজ বড় বড় পাতার ফাঁকে  সাদা জুঁই ফুলের থোকা।  আমার ভারী প্রিয়। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে  সেই ফুলগুলি  থেকে বেশ। কিন্তু পাতাগুলো যেন কেমন! অনেক বড়, পুরু পাতা।  ফুলগুলোও বড় ।  আমাদের গাইড, অনীশ এসে জানাল যে জুঁই ফুল নয়, এ হল কফি ফুল। হ্যাঁ, এই গাছই তো কিছু আগে রাস্তার ধারে ধারে দেখে এলাম। মে জুন মাসে কফি ফুলের গন্ধ নাকি সমস্ত বাগানে ছড়িয়ে থাকে। 

অনীশ, কলেজের ছাত্র। পড়াশোনার  সঙ্গে গাইডের চাকরি করছে। বেশ ছেলে সে! অনেককিছুই সেদিন জানতে পারলাম। –

ভারতবর্ষের কফি উৎপাদনের শতকরা ৭১ ভাগ  কফি উৎপাদন করে কর্ণাটক। এই উৎপাদনের ৩৩ শতাংশ কফি  কোদাগু বা কুর্গ জেলাতেই উৎপাদিত হয়ে থাকে। আরবিকা এবং রোবাস্টা এই দুই ধরণের গাছই এখানে দেখা যায়।


আরবিকা  কফি গাছের তুলনায় রোবাস্টা গাছ অনেক বড়। এক একটি গাছ একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে বেঁচে থাকে। রোবাস্টার পাতা অনেক বড় মাপের আরবিকার পাতার তুলনায়। দু ধরণের কফি গাছকেই ছোট করে ছেঁটে রাখা হয় ভালো ফলনের আশায়। কফি গাছগুলি মোটামুটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে এসেছে। উঁচু ঢালে বেশ কিছু  চকচকে কাণ্ড ও পাতার গাছ দেখে পরিচয় জানতে চাইলে অনীশ জানাল সিলভার ওক গাছ।  এই গাছগুলি কফি বাগিচার অপরিহার্য অঙ্গ। নতুন  কফি বাগিচার জমি তৈরীর সময় প্রথমেই লাগানো হয় সিলভার ওক। গাছগুলির অন্ততঃ বছর পাঁচেক  বয়স পার করবার পরেই ঐ বাগিচায় কফির চাষ শুরু হয়। কফির চারাগুলিকে  প্রখর রৌদ্রের খরতাপ থেকে রক্ষা করে থাকে সিলভার ওক। 


এছাড়াও ঐ বাগিচায় গোলমরিচ, ছোট এলাচ, দারচিনি ও তেজপাতা, জায়ফল , লবঙ্গ সবকিছুই ছিল।  মনে পড়ছিল  এই মশলার সৌরভেই একসময় ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যতরী  নিয়ে ভারতবর্ষে আসা যাওয়ার কথা এবং কিছুকালের মধ্যেই    ভারতবর্ষের রাজদণ্ডটিও অধিকারের কথা।  



দুই সারি গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরিচ্ছন্ন বাঁধানো রাস্তা। সন্ধ্যা হতে কিছু বাকি তখন। এমনই বাঁধানো একটি রাস্তার শেষে অদ্ভুত ধরণের ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে পেলাম। অনীশ জানাল পোকাগুলি প্রায় এক বিঘৎ লম্বা বলে।  একটি বিরাট উঁচু গাছ, লালচে শিকড়গুলি পাহাড়ের ঢালের মাটিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে – রক্তচন্দন গাছ।    অন্য পাশে দেখা গেল  বিশেষ ধরণের খুব ছোট ছোট লঙ্কার গাছ ,–নাম  Bird's eye chilly.  পৃথিবীর  খুব ঝাল লঙ্কার মধ্যে অন্যতম  এটি। এই লঙ্কা এবং এর থেকে তৈরী মদ স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ উপকারী। 


অন্ধকার হয়ে  এসেছে ।  বৃষ্টির গতি বেড়ে গিয়েছে  কিছু আগে থেকেই। সঙ্গে ছাতা থাকলেও  ভিজে  গিয়েছি।  যথাযথ সময়েই এরপর অনীশ নিয়ে এল  এস্টেটের coffee processing and roasting plant এ। টিনের চালে ঘেরা বড় একটি  হলঘর ।  বড় অংশে সারি সারি দেওয়াল জোড়া তাক। রকমারী জিনিসে ভরা।  গরম, ধোঁওয়া ওঠা কফির কাপ আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।  খুব  শীত করছিল তখন। কফি কাপ  হাতে পেয়ে বড় আরাম বোধ করলাম।  টিনের চালে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে।  বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।  অদ্ভুত সব পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সবকিছু মিলেমিশে শহুরে মনে  কেমন নেশা জাগিয়ে দিল !  কফিতে চুমুক দিতে  দিতেই চোখে পড়ল   হলঘরটির অন্য অংশে  নানারকম মেশিনের দিকে। কফি বিনস্ রোস্ট করবার মেশিনে রোস্ট করে তার মধ্যে মেশান হয় চিকোরি  –  কফির ক্যাফিনের মাত্রা কম করে  স্বাদ বাড়ানোর জন্য এই এস্টেট এ তেঁতুলের বীজ থেকে তৈরী করা হয় চিকোরি। তেঁতুলের বীজও গুঁড়ো হচ্ছে আলাদা মেশিনে দেখলাম। 


এরপর দেওয়াল জোড়া তাকের দিকে এগোলাম। কফির প্যাকেট ছাড়াও  সেখানে থরে থরে সাজানো  নানারকম মশলা, বাদাম, পেস্তা , কুর্গের বিখ্যাত চকোলেট। একপাশে বিশাল বিশাল বস্তা – বস্তার গায়ে লেখা গোলমরিচ , ছোট এলাচ, বড় এলাচ ইত্যাদি।  জানা গেল সব বস্তাই বিদেশ যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছু কেনাকাটা  করে আমরা বেরিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। 


বৃষ্টি অঝোরধারায় ঝরেই চলেছে। অন্ধকার  ভিজে রাস্তা , তার উপর গাড়ির কাঁচ বারেবারেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বেশ ভয় করছে তখন। 

শ্রীনিবাসদার গাড়ি চালানোর হাত সত্যিই চমৎকার।  ঘন মেঘ, কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারদিক। রাস্তা মোটেও দেখা যাচ্ছে না। চলেছি তো চলেছিই। বেশ ক্লান্ত লাগছে তখন। হোটেল কত দূর জানতে চাইলেই  শ্রীনিবাসদা চুপ করিয়ে দিচ্ছেন  ঠোঁটে আঙুল চেপে – গাড়ি চালাচ্ছেন অমন রাস্তায় বলে। খানিক বাদে আলো ঝলমলে মাডিকেরি টাউন এলে শ্রীনিবাসদা বললেন, 'হামকো ইধারকা গলি গলি পহচান হ্যায়। সহাব, হোটেল তো মেরা পহচান কা হ্যায়। বহুৎ আচ্ছা হ্যায়।  বললাম, হোটেল ম্যানেজার কে সাথ একবার বাত কর লিজিয়ে।  Address পুছ লিজিয়ে ।  বারবার পুছো মৎ অম্মা'  ---।  'ঠিক হ্যায়' বলে আমি তো সিটে গা এলিয়ে দিলাম।  কেন যেন মনে হচ্ছিল যে ঠিক রাস্তায় বোধহয় যাওয়া হচ্ছে না। যাই হোক,  অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে  টিমটিমে আলো জ্বালা এক বাগানঘেরা বাড়ির গেট খুলে শ্রীনিবাসদা গাড়ি নিয়ে দাঁড় করালেন। আমরা দুজনেই প্রায় একসঙ্গেই জিজ্ঞাসা করেছি, 'কহাঁ লে কে আয়ে'? গর্ব সহকারে শ্রীনিবাসদা ঘোষণা করলেন, 'ইয়ে হ্যায় আপকা হোটেল। হামকো হোটেল ওয়ালা পহচানতা হ্যায়। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। যাই হোক,  গাড়ি থেকে বেরোলাম।  শীতে কাঁপছি তখন। লোক নেই কোথাও। হোটেলে ঢোকবার রাস্তাও দেখছি না।  দুজনেই তখন বলাবলি করছি , এটা তো  কারোও বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। সে কথা শ্রীনিবাসদা শুনে রেগেও যাচ্ছেন।  শ্রীনিবাসদার  হাঁকডাকে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু  মুখে  বেরিয়ে এলেন। স্থানীয় ভাষায় শ্রীনিবাসদার সঙ্গে  দু চারটে কথাবার্তা চলছে তখন।  হাবেভাবে   আমরা ততক্ষণে বুঝেই গিয়েছি শ্রীনিবাসদা গোলমাল  করেছেন। মাথা চুলকে শ্রীনিবাসদার প্রশ্ন , 'আপকা হোটেল কা ক্যা নাম থা?'

শুনেই তখন কান্না পাচ্ছে।  'থা'??? ইয়ে নহী হ্যায়?  বারবার আপকো বোল রহে পুছ লিজিয়ে – ইত্যাদি।  খুব রাগ হলেও  তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলে হোটেলের ঠিকানা বুঝে নেওয়া হল।  তখনও শ্রীনিবাসদার একই কথা – "মাডিকেরি কা গলি গলি মেরা পহচান কা হ্যায়।" 

আমার স্বামী বললেন, "ঠিক হ্যায়। অভি চলিয়ে।"

শেষ অবধি পৌঁছেই গেলাম আমাদের এক রাতের আস্তানায়।  রাতের খাওয়া সেরে খুব তাড়াতাড়ি বিছানায় কম্বলের নীচে ক্লান্ত শরীরকে রেখে নিজেকে  পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষের মধ্যে একজন মনে হল।  বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে পায়ের মল বাজিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বৃষ্টিরাণী। ঝিম ধরানো  পরিবেশ।   অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। 

পরদিন সকাল নটায় বেরিয়ে পড়লাম। চারিদিক হালকা মেঘের চাদরে ঢাকা তখন। বৃষ্টি হয়েই চলেছে।  কখনও জোরে, কখনও বা একটু কম। খুব হাওয়া। পৌঁছলাম Raja's Seat garden এ।  কুয়াশা ঘেরা উঁচু নীচু ঘন সবুজ পর্বতশ্রেণী বেষ্টিত এই  দ্রষ্টব্যস্থান   একসময়ের কোডাভা  (কুর্গ বা মাডকেরির স্থানীয় অধিবাসী) রাজা রাণীদের সূর্যাস্ত দেখা বা অলস সময় কাটানোর জন্য পরিচিত ছিল। বড় সুন্দর এই বাগিচা। মেঘের চাদরে মোড়া ছিল সেইদিন। দূরের পাহাড় আমাদের দৃষ্টির গোচরে আসে নি তাই। না হলেও  একটুও দুঃখ হয় নি।  সে যে কি  মায়াময় পরিবেশ !  লিখতে বসেও মনে হল  সেই মেঘের চাদর যেন আলতো পরশ বুলিয়ে গেল!



এরপর গন্তব্য আব্বি ফলস্। কাবেরী নদীর উচ্চপ্রবাহে এই ঝরণা। শ্রীনিবাসদা গতকালের ঘটনার পর একটু চুপচাপ আজ। গম্ভীরভাবে বলে দিলেন আধ কিলোমিটার দূরে পার্কিং থেকে ঐ বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে যেতে হবে ফলস্ দেখতে। একটু কাছে নামিয়ে দেওয়ার অনুরোধ দু চারবার করলাম। তারপর শ্রীনিবাসদা আমাকে বললেন, গাড়ি স্লো করেগা, আর পটপটা উতর যানা অম্মা ! আমি যেদিকে বসেছি সেদিকের দরজার লক একটু সমস্যা করছিল অন্ততঃ আমার হাতে। সেকথা বলতেই শ্রীনিবাসদা উত্তেজিত হয়ে বললেন, তুমকো গাড়ি কা দরওয়াজা খোলনা আতা হী নহী। আমি চুপচাপ মেনেই নিয়েছিলাম সেদিন। যদিও খুব হাসি পেয়ে গিয়েছিল।  যাই হোক, সেদিন 'পটপটা' নামতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিলাম।


কফি ও সুগন্ধি মশলার বাগান  – বাগান তো নয় – বরং বলা ভালো  ঘন জঙ্গল – আকাশ দেখা যায় না গাছের পাতার  ফাঁক দিয়ে –  তারই  মাঝখান দিয়ে  ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে আব্বি ফলসের বাঁধানো রাস্তা। বৃষ্টি তখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। ভিজতে ভিজতেই  দুই পাশের ঘন সবুজ দেখতে দেখতে এগিয়ে  যাওয়া।  মাথার উপর সবুজ চাঁদোয়া থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে বৃষ্টির জল।  কতরকমের কীট পতঙ্গের ডাক জঙ্গলের মধ্যে দিনের বেলাতেই !  সঙ্গে  অবিরাম  রিমঝিম  ধ্বনি । কিছু পরেই দেখা হল বর্ষার উত্তাল কাবেরীর অন্য আর এক রূপের সঙ্গে।   চারিদিক  ঘন কালচে সবুজ জঙ্গল ঘেরা  উঁচু পাহাড় বেয়ে লাফিয়ে  লাফিয়ে নামছে  পূর্ণযৌবনা উচ্ছল কাবেরী।  ফলস্ এর কাছাকাছি  একটি ভিউ পয়েন্ট সুন্দর করে বানান।  তিন ধাপে  ঝর্ণার রূপে  নেমে এসে  কাবেরী বয়ে চলেছে  দুরন্ত গতিতে ।  মাথার উপরে গাঢ় ছাই রঙা আকাশ, ঘন সবুজ পাহাড় ঝর্ণাকে ঘিরে আর  লালচে ঘোলা জল – কি অপরূপ প্রকৃতি!  দু চোখ ভরে  দেখেও যেন আশ মেটে না। 

ফিরে এলাম গাড়িতে। আমাদের সেইদিন বিকেলেই  মহীশূর স্টেশন থেকে বেঙ্গালুরুর ট্রেন ধরবার কথা। তাড়াহুড়ো করতেই  হল।  এইটুকু সময়ে অনেক  কিছুই   হল না।  কাবেরী নদীর উৎস বেশী বৃষ্টির জন্য অধরা রয়ে গেল ।  স্থানীয় উপজাতি, কোডাভাদের সঙ্গে কথা বলা হল না।  বীর সেনানী এঁরা।  ফিল্ড মার্শাল কারিয়াপ্পা এই অঞ্চলেরই মানুষ ছিলেন। কোডাভা মহিলাদের সৌন্দর্য্যের খ্যাতি দেশজোড়া।  ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের মানুষজনের সান্নিধ্যে লাভের  আশা নিয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হলাম।  

বড় সাধ ছিল পাহাড়ে বৃষ্টি দেখার, শখ ছিল বর্ষায় পাহাড়ে রাত কাটানোর! কম সময়ের জন্য হলেও এই  ভ্রমন আমার সুখস্মৃতির ঝুলিকে অনেকটাই ভরিয়ে দিল।

ফেরবার  সময়েও ছাই রঙা মেঘ থেকে পাহাড় বেয়ে  ঘন জঙ্গলের মাথা  ছুঁয়ে বৃষ্টি  হয়েই চলেছিল।  বৃষ্টির বেগ  একটু কমলেই   দলে দলে মেঘেদের ভীড় গাড়ির জানলার কাঁচে! তারা যেন কত কিই বলতে চেয়েছিল সেদিন ! অদ্ভুত এক অনুভূতি! আমার সম্পূর্ণ মন প্রাণ বর্ষার প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এমন মায়ায় ভরা জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি অংশ আমিও – এই একাত্মতার  অনুভব আমার আনন্দকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।  ঘরে ফিরেছিলাম পরিপূর্ণ মন নিয়ে।

*সব ছবি লেখকের নিজস্ব 

*ছাত্রী, ১৯৮৯

মন্তব্যসমূহ

  1. মূল্যবান লেখা। আরও লিখুন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. পড়ে মন্তব্য করবার জন্য ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলাম।

      মুছুন
  2. কফি ফুলের সুগন্ধের মতোই স্নিগ্ধ, শান্তির প্রলেপ লাগলো মনে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাছেদের মাথা ছুঁয়ে বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণে মন ভিজে গেল।
    এমন সুন্দর প্রকৃতিময় তথ্য সমৃদ্ধ লেখা পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো মৌসুমী দি ❤️

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক শুভকামনা রইল। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুব আনন্দ পেলাম।

      মুছুন
  3. পরিণত লেখা। পড়তে পড়তে আমার ও মানস ভ্রমণ হয়ে গেল

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়