ওরা ভালো আছে কি

 নবান্বিতা মিত্র 




'পৃথিবীটা হারিয়ে যাবে
৫০০ বছর পরে
হারিয়ে যাবে অনেক প্রাণী
তোমার অত্যাচারে'
-- কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় 
 

'একে রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর' -- কথাটি নিছক একটি বাংলা প্রবাদ হলেও আজ সমগ্র ভারতবাসী তো বটেই বিশ্ববাসীও এই কথাটির তাৎপর্যতা যে কতখানি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। একে তো করোনা অতিমারি প্রাদুর্ভাব অন্যদিকে বারবার প্রকৃতির মারন প্রত্যাঘাত আজ ভারতবাসীকে 'Work from Home'-এর মতো শারীরিক শান্তি দিলেও মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছে। তাই অতি সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা যদি বলতেই হয় তাহলে সর্বপ্রথম 'তাউটে' ঘূর্ণিঝড়ের কথা উল্লেখ করতেই হয়। অতি ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় 'Tauktae' (বর্মী উচ্চারণ) গঠিত হয় ১৪ ই মে, ২০২১ সালে। 'Tauktae' নামটি মায়ানমারের দেওয়া। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৯৫ কিমি। আরব সাগরের উপকূল অঞ্চলে এই ঝড় আছড়ে পড়ে। ভারতের দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউ, গোয়া, গুজরাট, কর্ণাটক, কেরল, লাক্ষাদ্বীপ, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া যদি আরও অতি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলি তাহলে গত ২৬ শে মে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার বুকে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কথা না বললেই নয়। অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াসকে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ প্রথম পর্যবেক্ষণ করে ২৩ শে মে পূর্ব বঙ্গোপসাগরে একটি সাধারণ নিম্নচাপ রূপে। এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম ইয়াস, যা ওমানের দেওয়া নাম। গত ২৬ শে মে ঝড়টি ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে। এই ২৬ শে মে দিনটি ইয়াস আগমনের দিন হিসেবে চিহ্নিত করন করা হলেও, ঠিক যেমনভাবে ১৭৫৬ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ বাংলা দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন নবাবের বিশ্বস্ত বেশকিছু সভাসদগণ তেমনভাবেই ইয়াসের শক্তি বৃদ্ধিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল ওই একই দিনে সংগঠিত পূর্ণিমা ও চন্দ্রগ্রহণ। তার ফলে সমুদ্রের জলস্তর আরও বেড়ে যায়। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যে কতখানি তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরে ইয়াসের ধাক্কা সবচেয়ে বেশি জোরালো হয়। রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্যের প্রাথমিক খতিয়ান অনুসারে প্রায় ১২টি গ্রাম, ৯ লক্ষ মানুষ, ২৩৬ টি গবাদিপশু, ৫০ হাজার হেক্টর চাষের জমি, আট হাজার হেক্টর আনাজ-ফল-ফুলের জমি, ১৫০ কিমি রাস্তা, ৭২ কিমি বাঁধ, ১৫০০০ কিমি বৈদুতিক তার এই অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অঞ্চলের ১৮৯৬ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। অন্যদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে ইয়াসের প্রভাব সেভাবে না পড়লেও অতিমাত্রায় জলোচ্ছ্বাসের কারণে পাথরপ্রতিমা, সাগর, কাকদ্বীপ, নামখানা, গোসাবা প্রভৃতি জায়গায় বাঁধ ভেঙে প্লাবনের কারণে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। অসংখ্য মানুষ অতিমারির কথা ভুলে নিজেদের বাসস্থান বাঁচাতে তৎপর হয়ে পড়ে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের পুরো রোষ গিয়ে পড়ে প্রকৃতির ওপর। কিন্তু সত্যিই কি এই দুর্যোগের জন্য প্রকৃত দায়ী, মানুষের কি কোনো প্রভাব নেই এইসব বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টিতে?

যদি ফিরে যাই আবার সেই পুরনো বাংলা প্রবাদে -- 'এক হাতে কি তালি বাজে?' -- কথাটা কি যুক্তিযুক্ত নয় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে?

'গাছপালা সব ধ্বংস হবে
বাড়বে মরুভূমি
সবুজ গ্রহের একি দশা
করলে মানুষ তুমি?'
-- কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

এই কথাটি ১০০% যুক্তিযুক্ত। মানুষ বড়ই লোভী ও স্বার্থান্বেষী। মানুষের চাহিদার কোন অন্তঃ নেই। প্রকৃতি তো বটেই, এসব দুর্যোগ সৃষ্টির পেছনে মানুষের অবদান কম কিছু নয়। তাইতো দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর বার্ষিক বোর্ড পরীক্ষায় প্রত্যেকে (স্বয়ং আমিও) বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার, শুভ চিন্তায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এইসব রচনাগুলি লিখে আসা ও জেনে আসার পরেও কেবল স্বার্থের জন্য মানুষ তা অবলীলায় ভুলে যায়। কেই বা চিন্তা করে বলুনতো যে ঠান্ডা ঘরে থাকবো না, এসি-ফ্রিজ বেশি চালাবো না ফলে ওজোন স্তর বাঁচবে। কেই বা চিন্তা করে বলুনতো যে অনবীকরণযোগ্য সম্পদ (কয়লা, খনিজতেল প্রভৃতি) কম মাত্রায় ব্যবহার করব, তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচতে পারবে। স্থিতিশীল উন্নয়ন পরিকল্পনা আজ শুধুই পরীক্ষার খাতাতেই সীমাবদ্ধ, প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কে তা কি একবার হলেও করাঘাত করেছে? বড় বড় Multi-storey বিল্ডিং, শপিং মল, সিনেমা হলে সিনেমা দেখার স্বপ্ন কি মানুষকে বাধ্য করেনি বিপুল সংখ্যায় উদ্ভিদ নিধন করতে? তাই এক্ষেত্রে মানুষও কি খুনির ভূমিকা অবলম্বন করে নি? তাই কিভাবে এইসব দুর্যোগ সৃষ্টির দায়ভার শুধু প্রকৃতির হলো? মানুষের অজ্ঞানতা অসচেতনতাই তো যথেষ্ট এই দুর্যোগ সৃষ্টির পেছনে। প্রত্যক্ষ কারণ যদি বা বাদই দিই, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের সমাজবদ্ধ থাকার ধারণার যে বিলুপ্ত হয়েছে তা কি সত্যি নয়? নইলে বলুন না, ইয়াসের প্রভাবে যখন একদল মানুষ অসহায় ভাবে বুক পেতে বাঁধ আগলাচ্ছে, কেউবা ঘরের শেষ খুঁটি ও পরিবারকে আগলে রামনাম জপ করছে, কেউবা সমস্ত কিছু হারিয়ে হাহাকার করছে আর অন্যদিকে একশ্রেণীর মানুষ বাড়ি বসে বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে মিম বানিয়ে চলেছে যে কোথায় ইয়াস? কিছুই তো হল না তাদের সেই অঞ্চলে! তাদের পূর্বপরিকল্পনা যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। এই সমস্ত চিত্র দেখে একটি কবিতা লিখেছিলাম যার কিছু লাইন এখানে না বললেই নয় --

'ওই পাড়েতে আকাশ কালো
ধ্বংসলীলায় ভরা-
এই পাড়েতে শান্তিরা তাই
ছন্দে কাটে ছড়া।'
-- (নিজস্ব রচনা)

কিন্তু আর কতদিন আর কতদিনই বা প্রকৃতি মেনে নেবে বলুনতো! শুধু কি প্রকৃতি; কত পশুপাখি, বন্যজন্তু আজ এই দুর্যোগের কবলে বিপর্যস্ত। আর কতদিন, আর কতদিন মানুষের এই অত্যাচারের জন্য বারবার বিপর্যস্ত হতে হবে প্রকৃতিকে ও এক শ্রেণীর মানুষকে?

তবে আশার কথা হলো এর মাঝেও ব্যতিক্রমীরা আসে। তারা সর্বশক্তি দিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তারা সোশ্যাল মিডিয়াকে সাময়িক আনন্দের জন্য নয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করার মাধ্যমে নিজেদের মানবিকতার পরিচয় দেয়। কেউ বা কোভিড প্রোটেকশন নিয়ে সমস্ত প্রোটোকল মেনে সেই অবস্থাতেও পৌঁছে যায় দুর্গত পীড়িত অঞ্চলে। কেউ বা হাত লাগায় অস্থায়ী এনডিআরএফ কর্মী হিসেবে। এই অবস্থায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকেও স্বীকার করতে হয়। বিভিন্ন রকম প্রকল্প ও সাহায্যের মাধ্যমে তারা প্রতিনিয়ত দুর্গতদের পাশে থেকেছে।

তাই এত কথা বলার শেষে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সকলের কাছে এটুকু অনুরোধ যতটা পারবেন নিজেকে সচেতন করুন। এখনই যদি শুরু না করেন তবে ভবিষ্যতে আসন্ন বিপদকে কেউ আটকাতে পারবেনা। নিজের জন্য না হোক, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সেইসব দুর্গতপীড়িত মানুষদের জন্য অন্তত একবার চেষ্টা করুন। যখনই নিজেদের মধ্যে সচেতনতার অভাব দেখা দেবে তখনই নিজেকে প্রশ্ন করুন -- 'ওরা ভালো আছে কি?'

তাই প্রকৃতিকে বাঁচান। কে বলতে পারে হয়তো কোনদিন জীবনানন্দ দাশের মত আপনিও এইভাবে খুঁজে পেতে পারেন নাটোরের বনলতা সেনকে।


*ছাত্রী, সাম্মানিক তৃতীয় অর্ধবর্ষ 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অপেক্ষা

প্রথমা

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা