নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ

 দেবস্মিতা সরকার





বছর তিনেকের অবন্তিকা গুটি গুটি পায়ে ডান্স ক্লাসে এসে ঢুকলো।সপ্তাহের একটা দিন ছোট্ট অবন্তিকার নাচের তালিম নেওয়ার দিন।ডান্স ক্লাসে ঢুকে নিঃশব্দে একপাশে বসে নিজের তালিমের অপেক্ষায় থাকতো সে।বছরের পর বছর এইভাবেই চলতে থাকে অবন্তিকার 'নাচের ক্লাস'।একটা করে বছর পেরোতে লাগলো সাথে বাড়ল অবন্তিকার বয়েসের মোমবাতির সংখ্যাও।পড়াশোনার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চললো নাচের তালিম নেওয়া।রবীন্দ্র নৃত্য দিয়ে পথ চলা শুরু হলেও একে একে কত্থক,ভারতনাট্যম সবই অবন্তিকার শেখা হলো।
কিন্তু জীবনের অঙ্গনে আকস্মাৎ পরিবর্তন অদৃষ্টের নিষ্ঠুর লিখনে বোধ করি লেখাই ছিল।অপ্রত্যাশিত বিতর্কিত এক মোড় নিলো অবন্তিকার জীবন।২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক রবিবারে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন অবন্তিকার বাবা।যেন মাঝ সমুদ্রে বিধ্বংসী ঝড়ের তান্ডবে জাহাজডুবি।ঝড় একসময় থামলো, কিন্তু সেই ঝড়ে হারিয়ে গেলো বছর পনেরোর অবন্তিকার সবথেকে 'ভালোলাগা', তার 'নাচ'।বন্ধ হয়ে গেলো নাচের তালিম নেওয়া।
থেমে গেলো 'মম চিত্তে নিতি নৃত্যে 'র সাথে তাল মেলানো, থেমে গেলো তবলার বোলের সাথে মেলানো ঘুঙুরের ছন্দ।দিন পেরোয়, মাস যায়, বছর ঘোরে। বদল ঘটে জীবনের বহু অধ্যায়ের।ফিরে আসেনা কেবল অবন্তিকার হারিয়ে যাওয়া সেই 'ভালোলাগা ', অবন্তিকার নাচ।সেই যে নাচের তালিমে ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিল সে, আর শুরু করা হয়ে ওঠেনি তা।যেন এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিজের সবচেয়ে বেশি ভালোলাগাকে গলা টিপে খুন করে দিয়েছিল অবন্তিকা।লেখাপড়াকে একমাত্র সম্বল করে জীবনের পথে হাঁটতে থাকে সেদিনের অবন্তিকা।
এই সব কিছুর মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর।স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে নিজের পছন্দের বিষয় 'ভূগোল' নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয় এবং একে একে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে অবন্তিকা।বছর ত্রিশের অবন্তিকা এখন কলকাতার একটি নামজাদা শিক্ষায়তনের প্রফেসর।কর্মব্যস্ত অবন্তিকা প্রায় ভুলতেই বসেছিল ছেলেবেলায় খুইয়ে ফেলা সেই 'ভালোলাগা 'র কথা।বহু বছর তা মনের চোরাকুঠুরিতে বন্দী।হঠাৎই যেনো আজ আবার সেই 'ভালোলাগা ' অবন্তিকার স্মৃতিকে নাড়িয়ে দিল।
সম্ভবত দিনটা ছিল কালীপুজোর পরের দিনএক বিশেষ জরুরি কাজ সেরে ফেরার সময় অবন্তিকার চোখ পড়ল রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট মঞ্চে কতগুলো আট কি দশ বছরের মেয়ে নৃত্য পরিবেশন করছে।দেবী বন্দনা উপলক্ষ্যে হয়তো পাড়ার সান্ধ্য অনুষ্ঠান।সেদিকে চোখ পড়তেই অবন্তিকার মনে পড়ল সেও একসময় কত অনুষ্ঠানে নিজের টিমের সাথে পারফরমেন্স করেছে।সেসব দিন কতই না স্মৃতি মধুর। ভাবনায় ডুবন্ত অবস্থাতেই অবন্তিকা ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল।গাড়ি থেকে এক পা এক পা করে মন্ত্র মুগ্ধের মত এগিয়ে চললো সেই মঞ্চের দিকে। বড্ড ভালো নাচছে ওইটুকু বাচ্চাগুলো।আর একটু হলেই একটা পড়ে থাকা ইটে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেত।ঠিক তখনই বছর ষোলো কি সতেরোর একটি মেয়ে এসে ধরে ফেলে অবন্তিকাকে।অবন্তিকা রীতিমত চমকে উঠে সজ্ঞানে ফিরে একবার মঞ্চের দিকে একবার মেয়েটির দিকে তাকায়।অবন্তিকা নিজেকে সামলে নিয়েছে দেখে মেয়েটি অন্য দিকে ঘুরে চলে যেতে যাবে এমন সময় অবন্তিকা মেয়েটিকে প্রশ্ন করেমঞ্চে নৃত্যরতা ঐ বাচ্চা মেয়েগুলোর ব্যাপারে।
ষোড়শী মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয় যে বাচ্চা মেয়েগুলোর বাস পাশের বস্তিতে এবং সে নিজেও সেখানেই থাকে।মেয়েগুলোকে সে নিজেই নাচের তালিম দেয়। একসময় সেও একটা ছোট্ট ডান্স স্কুলে নাচের তালিম নিয়েছে।অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু নাচ নিয়ে নিজের স্বপ্ন আর নাচের প্রতি তার ভালোলাগাকে বিসর্জন দিতে চায়নি বলেই ওই বাচ্চা মেয়েগুলোকে নিয়েসে তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। নির্বাক শ্রোতা হয়ে অবন্তিকা সব শুনলো।অবন্তিকা আবার স্মৃতিচারণ করলো।
সে ও তো একদিন ঠিক এই বয়সেই নিজের ভালোলাগাকে চিরতরে কারাবাসে পাঠিয়ে দিয়েছিল। 'কিন্তু আর নয়'।যেন ঘুমন্ত অবন্তিকা জেগে উঠে নিজের মনেই বলে উঠলো।
নিজের ভালোলাগাকে বাস্তবায়িত করতে পারেনি তো কি হয়েছে , এই ষোড়শী মেয়েটি নিজেকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছে তা তো বাস্তব রূপে আনাই যায়। যেমন ভাবা তেমনই কাজ।
পরদিন সেই বস্তিতে গিয়ে ষোড়শী মেয়েটি আর ওই বাচ্চা মেয়েগুলোকে খুঁজে বের করে সঙ্গে করে নিয়ে যায় বিখ্যাত নৃত্যগুরু মমতা শংকরের ডান্স একাডেমীতে অ্যাডমিশন - এর জন্যে।একদিন অবন্তিকার কাছে এই একাডেমী ছিল স্বর্গ তুল্য।কত স্বপ্ন দেখেছিল এই একাডেমী নিয়ে। ষোড়শী মেয়েটি যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার ন্যায় আনন্দে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো।সমস্ত শর্তাবলী মেনে প্রত্যেকের নাম একাডেমীতে নথিভুক্ত করায় অবন্তিকা।তাদের নাচ শেখা থেকে শুরু করে সেই ক্ষেত্রের সমস্ত ভার অবন্তিকা নিজে বহন করার সিদ্ধান্ত নেয়।শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
অবন্তিকার জীবনের যে অধ্যায় আজ বছর পনেরো আগে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই অধ্যায়ের নতুন রূপে সূচনা হয়।
সেদিনের সেই মেয়েগুলোর মধ্যে অবন্তিকা খুঁজে পেয়েছিল তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার 'ভালোলাগা'।স্বপ্ন যেন ঐ অনাহার ক্লিষ্ট বস্তির এক অন্ধকারে নিমজিত ষোড়শী মেয়েটির পূরণ হয়নি, হয়েছে যেন তার নিজের।যে 'ভালোলাগা'কে একদিন নিজেই চোরাকুঠুরিতে অনন্ত অসীম কারাবাস দিতে বাধ্য হয়েছিল সে, আজ যেন তারই মুক্তিলাভ ঘটেছে।
দশতলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে হাতে কফির কাপ নিয়ে রাতের কলকাতার আস্বাদ নিতে নিতে নিজের 'ভালোলাগা', হ্যাঁসেই 'ভালোলাগা'কেই উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলে উঠলো নৃত্যেই তোমার মুক্তির রূপ মিলল তাহলে।।


*ছাত্রী, সাম্মানিক তৃতীয় অর্ধবর্ষ

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা