সময় এসেছে পাল্টানোর

২০/১০/২০২০

. মলয় মুখোপাধ্যায়* 

পৃথিবীর ছাপাখানায় নানান ধরনের বিপর্যয়ের খবর অনেকবার ছাপা হয়েছেবিপর্যয়ে মানুষ সাময়িক থেমেছে, তারপর ঝেড়ে মুছে আবার সাজিয়েছে তার সভ্যতা কোনো কোনো সমাজ তরতড়িয়ে ভুল পথে এগিয়েছে, কেউ কেউ আবার শান্ত মনে মাটির উপর শক্ত পা ফেলে ধীর গতিতে এগিয়েছে উত্তরটা হলো সভ্যতাকে এগিয়ে চলতেই হবে গাঢ় অতীতের সেই আলো অন্ধকার মাখা গুহা জীবন থেকে মানুষ আজও আর একটু সুখের আশায় একটার পর একটা নতুন ঘরের চৌকাঠ পার হয়ে যাচ্ছে সময়ের সিন্দুকে কোথাও কোথাও এই নতুন ঘরের দরজা দমকা হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে, আবার কোথাও কোথাও সবকিছু ভেঙে পড়ছে চোখের সামনেইমানুষ কখনো শিক্ষা নিয়েছে, কখনো বা দুর্বল আস্ফালন করেছে মগজে হাত ডুবিয়ে ভুল পথের শেষে দুশ্চিন্তারা জায়গা দখল করে নিয়েছে সভ্যতার এই টানাপোড়েনকে প্রশ্রয় দিয়ে পরিবেশ দার্শনিক তথা নবনিয়ন্ত্রনবাদী উন্নয়নপন্থী ব্রিটিশ বংশোভূত অস্ট্রেলীয় ভূগোলিক গ্রিফিট টেলর (১৮৮০-১৯৬৩) তাঁর 'স্টপ এন্ড গো' (Stop & Go) মতবাদকে প্রতিষ্টা করেন এই মতবাদের মূল সুরকে সমর্থন করে তিনি যেন বলতে চাইলেন, মানুষ তোমরা তোমাদের সভ্যতার দালানবাড়িতে মাঝেমধ্যে একটু থামো তোমার অতি গতির স্বভাবগুলোকে একবার চোখ বুজে অনুধাবন করো, তোমার যাত্রাপথ ঠিক না বেঠিক সেটা তুমিই নির্ধারণ করো যদি জানতে চাও যে কখন কোথায় থামতে হবে?  উত্তরে বলবো, সে তো প্রকৃতি জানান দেয় তার মাঝে মধ্যে নানান ঘটনার উপস্থিতিতে

আসলে মানুষ তাঁর ভোঁতা বুদ্ধিতে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না অথবা বুদ্ধির অহংকারের খোলসে বুঝতেই চায় না দমকা ঝড়, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, হাড়ে ঠেকে থাকা ঠান্ডা বা সব কিছু শুষে নেওয়া গরম এসব হল প্রকৃতি মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন আরেকটু বড় করে ভাবলে হঠাৎ সুনামি, না জানিয়ে জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি অথবা সবকিছু এলোমেলো করে দেওয়া ভূমিকম্প আরো বড় করে ভাবলে তুষারযুগ, নোহার প্লাবনের মত মহাপ্লাবন পৃথিবী বারবার জানান দিয়েছে মানুষকে দার্শনিক গ্রিফিক টেলর বলেন, এগুলো হল 'Stop for a While' যা নিজেদের শুধরে নেওয়ার সুযোগ জ্ঞানবুদ্ধি বলে আসলে মানুষ নিজের নিজের ঘর সামলাতে আর সুখের চাষ করতে যাকে প্রথম পাশে সরিয়ে দিয়েছে তা হল পৃথিবীর অস্তিত্ব ইদানিং অবশ্য পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এই ভুলের প্রায়শ্চিত্তের আয়োজন চলছে অথবা যাতে না ঘটে তার তোড়জোড় শুরু হয়েছে এটাই স্বস্তির, শুভবুদ্ধির সূর্যোদয় মনে হয়

সাম্প্রতিক কালের করোনা ভাইরাস ভয় তেমনি এক স্টপ হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে একসারিতে এনে দিয়েছে এই করোনা ভয় পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ গোলার্ধের মানচিত্র এখন একটা রঙে আঁকা হচ্ছে, সে রঙের নাম ' - অসহায়তা করোনা ভয় মানুষের দম্ভ ও রাষ্ট্রসীমানা নিয়ে দর কষাকষি, বাণিজ্য উৎপাদন নিয়ে মনোমালিন্য, অস্ত্রের আধুনিকতার প্রতিযোগিতা, ধর্ম প্রতিষ্ঠার ছল চাতুরি সব কেমন যেন ফ্যাকাশে করে দিয়েছে এইসব ছেঁদো মিথ্যেগুলোকে পাশে সরিয়ে দিয়েছে মানুষ সভ্যতা যেন পবিত্র হতে চায় আসলে মৃত্যুভয় এসে মানুষের গায়ে ঠেকেছে মৃত্যু ভয়ের সীমানা মানচিত্র মানে নি যে এটার দরকার ছিল সভ্যতার বাড়বাড়ন্তে কোন দিকদিশারি ছিল না মানুষের

সাময়িক এই ভয় আর তার জন্য বন্দীদশা, অথবা হেরে যাওয়া হয়তো পৃথিবীর- পরিবারপ্রেমী ভৌগোলিক গ্রিফিথ টেলরের ভাষায় 'স্টপ' (Stop) জানিনা এরপর 'গো (Go) কোন পথ নেবে? শুভবুদ্ধি জড়ানো শান্ত জীবনচর্চায় কাটাবে মানুষ, নাকি যন্ত্রবুদ্ধির কাছে নতজানু হয়ে আবার ভুল পথে হাঁটবে নিজের কর্ম কৃতিত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে? এখন শুধু অপেক্ষা, কাছের ভবিষ্যতে আমরা করোনা ভয়কে অস্বীকার করে কতটা সাহস দেখতে পারবো? অভিজ্ঞতা বলে, ইতিহাস শিখিয়েছে যে কিছুদিন এই ভয়কে সঙ্গে করে মানুষ চলবে তারপর হয়তো সুখ আর ক্ষমতার হাতছানি আবার ভুল পথে নিয়ে যাবে মানুষকে দীর্ঘদিনের এই স্টপের পর এবার দেখা যাক 'গো' (Go) টা কোন পথ ধরবে? মানুষকে ঠিক করতে হবে সেটা

আমার সামান্য পড়াশোনা কিছু অভিজ্ঞতা থেকে যে পরিবেশকে ঘিরে দর্শন তৈরি হয়েছে হয়তো সেটাই হবে আগামী দিনের 'Go' আমাদের পৃথিবীর উপর নদী, পাহাড়, বনভূমি, সমুদ্র, জঙ্গল সব একটা নিয়মকে মেনে- ভারসাম্যের চাবিকাঠি, একে অন্যের পরিপূরক মানুষ এতদিন এর সাথে খাপ খাইয়ে নিজের জীবনচর্চা সাজিয়ে এসেছিলো সাহারার মানুষ অল্প জলে জীবন সাজাতো, পাহাড়ের উপস্থিতি সমতলের অবাধ বিস্তার মানুষ মেনে নিয়েছিল তারপর ক্রমশ মানুষের ভুল রাস্তায় চলা শুরু চাহিদার সঙ্গে প্রযুক্তির হাত মেলানো, বাসনা চরিতার্থ করতে পাহাড় সমতল হল কোথাও কোথাও, মরুভূমিতে কৃষিক্ষেত্র বিস্তার করল মানুষ, উচ্ছিষ্ট জিনিসের পাহাড় তৈরি ' সমতলে চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভের জলস্তর আরো গভীরে চললো নতুন এক পৃথিবী তৈরিতে মত্ত হয়ে উঠলো মানুষ, যা মোটেও বাঞ্চনীয় নয়

এবার মনে হয় মানুষ নিজেকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবে আর প্রকৃতি প্রতিটি উপাদানকে তাদের উপস্তিতিকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করবে এবার চলা হবে হাতে হাত মিলিয়ে, সুখের পরিসীমাতে লক্ষণরেখা টেনে মরুভূমির মানুষ সপ্তাহে একদিন বা মাসে একদিন স্নান করলে পৃথিবীবাসীর মঙ্গল অন্য অঞ্চলের মানুষদের নকল করে প্রতিদিন স্নান করা মানে প্রকৃতির ভারসাম্যে আঘাত করা, প্রকৃত বিজ্ঞান থেকে সরে আসা প্রযুক্তির কেরামতির ক্ষেত্রে অন্য, অন্যকিছুতে দেখানো হোক প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত, প্রকৃতির উপাদানকে উপেক্ষা করে নয় কারণ, প্রকৃতির উপাদানকে যদি আমরা আজ অবজ্ঞা করি, আগামী প্রজন্ম কিন্তু কৈফিয়ত চাইবে, 'কোন  বিজ্ঞানের উঠোনে তোমরা চলাফেরা করেছিলে?'

*অধ্যাপক প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান
ভূগোল বিভাগ, বিশ্ব ভারতী, শান্তিনিকেতন

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা