ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে

২০/১০/২০২০

জয়া ঘোষ* 

এক বিপন্ন সময! কাল করোনার বিষে জর্জরিত সারা পৃথিবী ভয়াবহ এই ভাইরাসের চক্রবুহ্য থেকে বেরোবার পথ খুঁজছে মানুষ।এই মারণ রোগ সারাবার ওষুধ, ভ্যাকসিন খুঁজে বার করবার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রাণপাত করে চলেছেন চলছে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ আকার নিয়েছে অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছে  করোনায় বিপর্যস্ত আমেরিকা। যদিও সংক্রমন এবং লক্ষাধিক মৃত্যুর নিরিখে শীর্ষ তালিকায় এখনো মার্কিন মুলুক। অন্তরীণ  জীবনে কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা বাইরে বেরোনোর ব্যস্ততা না থাকলেও কাজের শেষ নেই অনলাইনে অর্ডার করা বা সেগুলোকে এনে পরিষ্কার করে তোলা এক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এখন  প্রয়োজনে কোথাও বেরোলেই একটা গা বাঁচানোর চেষ্টা সকলের মধ্যেই আছে রাস্তায় বেরোলে প্রচুর গাড়ি দেখা যায়। লোকজন আর আগের মত ঘরবন্দি থাকতে পারছেনা জীবিকার প্রয়োজনে বা প্রশাসনিক কারণে তবে বিধিনিষেধ মেনে অনেকটা সংযত ভাবেই লোকে বাইরে বেরোচ্ছে এখন 

চরাচরের বন্ধ তালা অল্প স্বল্প খুলতেই মুক্তির আনন্দে হুড়মুড়িয়ে মানুষের স্রোত রাস্তাঘাটে, দোকানে রেস্তোরাঁ কিংবা সমুদ্র সৈকতে। ঠিক যেমনটি  শহর কলকাতায় পুজোকে ঘিরে উন্মাদনা আর উচ্ছ্বাস  ঘর বন্দি মার্কিন মুলুকের ছবিটা বদলাতে শুরু করেছিল মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই। মেমোরিয়াল ডে ছুটি আসতেই বেশ কিছু রাজ্য লক ডাউন তুলে সব কিছু খুলতে নির্দেশ দেওয়া মাত্র দেশের কিছু মানুষ সামাজিক দূরত্ব বিধি লঙ্ঘন করে অপ্রয়োজনে বাইরে বেরোতে শুরু করে দিল। সেই দেখে আবার ক্যালিফোর্নিয়ার বিনোদন মূলক বার রেস্তোরাতে নিষেধাজ্ঞা চালু হলো। 

আমেরিকায় প্রথম করোনায় মৃত্যু ক্যালিফোর্নিয়াতেই হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। ক্যালিফোর্নিয়া উন্নত হাইটেক রাজ্য যেখানে অগুনতি টেক কোম্পানিতে সর্বক্ষণ চীন বা ইউরোপের মানুষজনের যাতায়াত। আমেরিকার টেকনোলোজি হাব অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল স্যানফ্রান্সিকো বে এরিয়া। এখানকার  টেক কোম্পানিতে যুক্ত আছে প্রচুর দক্ষিণপূর্ব এশিয়া,ইউরোপের মানুষজন। এইসব অঞ্চলে সংক্রমণের খবর বাড়তেই মার্চের ১৯ তারিখ সরকারিভাবে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায় ওই দিনই ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর মার্কিন মুলুকে প্রথম 'শেল্টার ইন প্লেস' ঘোষণা করেন। আমেরিকা জুড়ে ৯০ শতাংশ মানুষ তখন গৃহবন্দীকেমন যেন অস্বভাবিক ধীর গতি এই চলমান সমাজে।  আতঙ্ক আর আশংকায় জীবন তখন অন্দরমুখী। হঠাৎ পাওয়া অবসরে কোন ব্যস্ততা নেই।   

ওষুধের নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট সবসময়ই খোলা ছিল। রেস্তোরাঁতে 'টেক আউট' আর 'ডেলিভারি' চলছিল। শুধু ব্যবধান মেনে চলা। সুপার মার্কেট গুলোতে অনলাইন কিনে নির্দিষ্ট স্পটে সময়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করলে ওরা এসে জিনিস গাড়িতে তুলে দেয় বা বা হোম ডেলিভারি রয়েছে। যেদিন ডেলিভারি সেদিন সময়মত ই-মেইল আসছে এবং নির্ধারিত পার্কিং স্পটে দাঁড়িয়ে ওদের ফোন করলেই, জিনিস গাড়ির পেছনে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু জিনিস ঘরে তোলার পর সবকিছু ক্লোরক্স ব্লিচিং দ্রবণ খানিকটা জল মিশিয়ে তাই দিয়ে সব জিনিসের প্যাকেট মুছে তুলে রাখা কাঁচা সবজি ফল ভালো করে ধুয়ে রাখা।  

যদিও জীবনে বাইরে বেরোনোর ব্যস্ততা কমেছে কিন্তু বেড়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার দুশ্চিন্তা। 

বহু মানুষ কৰ্মহীন। ক্যালিফোর্নিয়াতে ৩০ লক্ষ মানুষ বেকারভাতার জন্য আবেদন করেছেন মার্চের শেষে। এখন সমগ্র আমেরিকা জুড়ে প্রায় ৪০ মিলিয়ন (প্রায় কোটি) মানুষ সরকারি ভাতার ওপর নির্ভরশীল। এই ভাতাগুলোর জন্য মানুষ কোনরকমে চালিয়ে যাচ্ছে এই সর্বনাশা ভাইরাস এদেশের মানুষকে করেছে কর্মনাশা। মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আন্দোলন করেছেন।  দৈনিক রুজিরুটি যাদেরতাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। বহু অসহায় মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। গত আগস্ট মাসে স্কুল কলেজ অফিসিয়ালি খুলেছে সব জায়গায় দু ধরণের অপশন ছিল চাইলে স্টুডেন্ট স্কুল যেতে পারে আবার না চাইলে অনলাইনে পড়তে পারে তবে টিচারদের যেতে হচ্ছে স্কুল কলেজে মিটিং থাকলে বা অন্যন্য কারণে।  

স্কুল খোলার পর  দুসপ্তাহে প্রায় লক্ষ শিশুর করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। জুলাই মাসের শেষ দুসপ্তাহে আমেরিকায় শিশুদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়েট্রিক্স এবং চিলড্রেন্স হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশন। বেশিরভাগ কলেজেই ছাত্ররা বাড়ি থেকেই অনলাইনে পড়ছে যদিও এখন 

আমেরিকার শহরতলীর প্রকৃতি সবসময়ই শান্ত সুন্দর। কিন্তু এখন যেন আরো বেশি চুপচাপ। আমাদের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স একেবারে টিপটপ পরিষ্কার আর গাছ গাছালিতে ভর্তি। ক্যালিফোর্নিয়াতে এই স্প্রুস গাছ চারিদিকে। আমার কমপ্লেক্সে বাউন্ডারি ওয়াল ধরে আছে এই এভারগ্রিন ট্রি।  শুরুতে অস্বভাবিক ধীর গতি ছিল এই চলমান সমাজে। আগস্ট মাসের পর থেকে যখন একটু একটু করে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলো তখন থেকে লোকজনের মধ্যে একটু বেপরোয়া ভাব দেখলাম   আমার এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ক্লাবহাউস কিছুদিন জিমসুইমিং পুল পুলিশ খোলা রাখলো .আবার কিছুদিন পর বন্ধ হলো তারমধ্যে শুরু হলো বে-এরিয়ার আশেপাশে পাহাড়ে দাবানল দাবানলের ধোঁয়াটে মেঘ আমাদের এদিকেও প্রায় সপ্তাহ জুড়ে বাতাসের শুদ্ধতা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছিল তখন এমনকি বারান্দায় বেরোনোর উপায় ছিলনা টক্সিক বাতাসের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ায় এই ধরণের বনের আগুন প্রতিবছরই দেখা যায় অসম্ভব গরম শুষ্ক বাতাসের জন্য এই আগুন লাগে এবছর রেকর্ড হিট ছিল সাক্র্যামেন্টোতে, প্রায় ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াস।  কোন বৃষ্টি নেই।  এরই মাঝে প্রকৃতির ক্যানভাসে ঋতু বদলালো।  নীল আকাশে সাদা মেঘের খেলাভোরে শিশিরের স্নিগ্ধতা মনকে জানান দিয়ে গেল হেমন্তের আগমন বার্তা বহু প্রতীক্ষার পর এসে গেল উৎসবের মরসুম। প্রবাসীর প্রাণে এল পুজো আর এদেশের মানুষের মনে এলো 'হারভেস্ট সিসন' আর 'হ্যালউইনের' আনন্দ বাড়ি থেকে পড়াশুনা, বাড়ি থেকে বন্ধুত্ব, বাড়ি থেকেই কাজ। অসহায় এই সময়! সময় বয়ে যায় শুধুই সুসময়ের অপেক্ষায় !  


*ছাত্রী, ১৯৮৭

মন্তব্যসমূহ

  1. ভালো লাগল। মৌসুমী ব্যানার্জী

    উত্তরমুছুন
  2. বাহ্, শেষ লাইন টা খুব ভালো লাগলো। সুন্দর লেখা।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. Jaya tomar lekha aamar borabor i portey khub bhalo laage..ebar lekhata teo okhankar nana khabor pelam..manusher manoshik abostha r katha o bujhte paarlam..
    Lekhoni sab samay eirakom sachol rekho..bhasa note bolar kichhu nei..khub susanghato..
    Man8sha di

    উত্তরমুছুন
  5. বিদেশের কথা অনেক কিছু জানতে পারলাম, আমাদের দেশের অবস্থা ও এক রকম।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়