লকডাউনের জানলা
২০/১০/২০২০
লকডাউনের জানলা মানে আমার জানলা। কোভিড ১৯ এর লকডাউনে বাড়িতে আটকে আছি, আজ দুমাস পেরিয়ে তিন মাসে পড়ল। বাইরে বেরোতে পারছি না বটে, কিন্তু অবাক হয়ে যাচ্ছি, যে আমার বাড়িতে জানলা অনেক বেড়ে গেছে, এতগুলো জানলা আগে কখনও ছিলনা।
হাওড়ার ঘিঞ্জি গলিতে দোতলার ছোট ফ্ল্যাট। এক চিলতে বারান্দা, জানলার এক্সটেনশন। যে দিকে চাই, নজর আটকে বড় বড় বাড়ি। খুব কষ্ট করে ফালি আকাশ দেখা যায়। দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখি একটু রাস্তার আভাস। ঘরে রোদের মুখ দেখিনা তাই দিনেও বিদ্যুতের আলোয় কাজ চালিয়ে নিই। তিনটে ঘরে জানলা সাকুল্যে চারটি। এতদিন এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি, কারণ দরকার হয়নি। সকাল হলেই নাকে মুখে গুঁজে কলেজে ছুটি। বাড়ি ফিরতে সেই সন্ধ্যে। ঘরে রোদ হাওয়া ঢুকেছিল কিনা খোঁজ নিইনি কোনোদিন। ছুটি থাকলে রবীন্দ্রভারতীর
দূরশিক্ষার ক্লাসের জন্য সোজা সল্টলেক। নইলে কোনো মেলা, প্রদর্শনী, আমন্ত্রণ, একাডেমির নাটক বা পি ভি আরের সিনেমা। বাড়িতে থাকলে কম্পিউটারে লেকচার রেডি, খাতা দেখা আর রোজকার পড়াশোনা। ঘরের কাজ, রান্না এগুলো বেঁচে থাকার উপায়, তাই উল্লেখযোগ্য
কিছু নয়। এসবের মধ্যে বাড়িটা ছিল, বারান্দা আর জানলাগুলোও ছিল। আলাদা করে চোখে পড়তনা। কারণ বাড়িটা ছিল কেবল ঘুমোনোর জায়গা।
এখন আমি রোজ জানলায় আর বারান্দায় যাই। কিছুক্ষণ বসি অথবা দাঁড়িয়ে থাকি স্থির হয়ে, বলা ভালো সুস্থির হয়ে। ছোটবেলার গরমের ছুটির কথা মনে আসে। সেই দিনগুলোর পরে আমার জীবন কখনো এমন সুস্থির ছিলনা।
পিছনের বাড়িটার পাঁচিলের গায়ে, ছায়া পেয়ে অনেকগুলো ফার্ন গজিয়ে উঠেছে। ওদের গায়ে গায়ে ওটা তো পুঁইশাক মনে হয়। অনেক ছোটবেলায় বসিরহাটের দেশের বাড়িতে পাকা পুঁইমিটুলির
চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেতাম। ভাতটা লাল হয়ে যেত। পরে আর কখনো খাইনি। ওদের পেঁপে গাছটায় কত পেঁপে ধরেছে রে বাবা। সব কি ওরাই খাবে? তেমন আলাপ নেই। থাকলে দুটো চাইতাম। পাশে উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িটার সারা গায়ে দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় গাছ গজিয়ে উঠেছে। বাড়িটাতো বেশি দিন হয়নি! সুন্দর রং, মলিনতার ছাপ পড়েনি। এরা কি কিছু দেখেওনা। আচ্ছা আমাদের বিল্ডিং টায়ও এমন হয়েছে নাকি? আমার সামনেই ওদের দেওয়ালে পাইপের বাঁকে ঝাঁপড়া অশ্বথ্থের চারা।ওখানে বসে খুঁটে খুঁটে কিছু খাচ্ছে একটা সাদা বক। মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে, আবার বসছে। আশ্চর্য! আমি বাড়ি বসে এ তল্লাটে বক কখনো দেখিনি।
দুটো বিড়ালছানা ডানদিকের বাড়ির পিছনে খেলা করছে। একটা লালে সাদায় মেশানো, অন্যটা ঝিম কালো। ওদের মা এবাড়ি ওবাড়ির পাঁচিলে পাঁচিলে, পাম্পঘরের নিচু ছাদে ঘোরে। বাড়ি বাড়ি অভিযান ও চালায়। বারকতক আমাদের বাড়িও এসেছিল। পাখি আছে তো, সাবধান থাকতে হয়। সপ্তা দুয়েক আগে সারা রাত ম্যাও ম্যাও কান্না। জানলা দিয়ে ঝুঁকে দেখি, ছানা হয়েছে, তাদের নিয়ে বসে আছে। কিন্তু হল টা কী? আজ তো ঝড় জল কিছু নেই। সকালে জানলাম তিনটে ছানার একটা ছানা মরে গিয়েছে। আহা রে, ঐজন্যই কাঁদছিল।
লকডাউনের মধ্যে অনেকেই চলে গেলেন, চুনী গোস্বামী, ইরফান খান, ঋষি কাপুর, আমার নিজের মেসোমশায়। ফোন আর টিভির জানলা দিয়ে দেখলাম, বেরোতে পারলাম না। শুধু ঘরের জানলার সামনে তাকিয়ে রইলাম বাইরে। একচিলতে আকাশে জ্বলজ্বলে অনেক তারা। রাস্তায় গাড়ি নেই, তাই ধোঁয়া ধুলোর পরত গেছে মুছে। এত পরিষ্কার আকাশে কি প্রিয় মানুষদের খুঁজে পাওয়া যাবেনা?
বুদ্ধপূর্ণিমার
রাতে, আমার শোবার ঘরের জানলা দিয়ে রোদ্দুর পড়ল ঘরে। এল কোথা থেকে? গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ে দেখি একচিলতে আকাশে হাজার ওয়াটের এল.ই.ডি বাতি হয়ে ঝলমল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। হতবাক হয়ে যাই। জীবনে একবার শ্বশুর বাড়ির গ্রামে এক লক্ষ্মী পুজোর রাতে পথ হেঁটেছিলাম এমনই জোছনা মাখা রোদ্দুরে। সে রোদ্দুর শহরের ঘিঞ্জি গলিতে আমার বাড়িতে!!! বিশ্বাস হতে চায়না।
আজকাল অবিশ্বাস্য অনেক কিছুই ঘটছে। চড়ুই-এর ডাকে ভোর থেকে কান ঝালাপালা। বেরোনোর তাড়া নেই, একটু বেলা করে যে ঘুমিয়ে থাকবো তার জো টি নেই। খেয়াল করে শুনি, দুরকম আওয়াজ আসছে। একটা সাধারণ, আর একটা আরও মিহি একটানা চুঁ চুঁ। একটার পর অন্যটা। ঠিক যেন সংলাপ। জানলায় পর্দার আড়ালে আড়ালে তদন্ত চালাই। ব্যাপার বুঝে তো আমি থ। মেয়ের আবদারে, কলেজের সামনে শচীনদার কাঠের দোকান থেকে বানিয়ে এনেছিলাম পাখির বাসা। ঘটা করে জানলায় বাঁধা হয়েছিল। এতদিন লাভ কিছু হয়নি। লকডাউনে সেটি বারান্দার মাথায় বাঁধা হল। কর্তা সময় কাটাতে টবে শসার চাষ করছিলেন। সবুজ নরম ডাল, আর বড় বড় পাতা আমাদের বারান্দার গ্রিল ছেয়ে ফেলেছে। কাঠের বাক্সেও এখন পাতার আড়াল। ভরসা পেয়ে এতদিনে চড়ুই দম্পতি সেখানে সংসার পেতেছে। সেই সংসারেই আজ নতুন অতিথি। কাঠের বাক্সটা এতদিন পড়ে আছে। সেখানে নতুন প্রাণ আসবে, আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। বারান্দা থেকে শসা পেড়ে, রায়তা করে, স্যালাড করে, লম্বা কেটে নুন মরিচ মাখিয়ে কচমচিয়ে খাবো, একথাই কি ভেবেছি কোনোদিন? চড়ুইছানাদের
কলরব আর তদের বাবা মায়ের ব্যস্ততা, ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ আসা যাওয়া দেখে কলেজের হৈচৈ এর কথা মনে পড়ে। ক্লাসের সময়ে, কাজের সময়ে হট্টগোলে কত বিরক্ত হয়েছি, আজ সেই হট্টমেলায় মন টানে। ছেলেমেয়েদের
সাথে অনলাইনে দেখা হয়। পুরোনো ল্যাপটপটা জাদুবলে আজ জানলা হয়ে উঠেছে।
![]() |
| বারান্দায় শসার চাষ |
![]() |
| পাখির বাসা |
আজ এখন টিভি, ফোন, ইন্টারনেট সব জানলা বন্ধ। তবু নিজেকে বলি সব তালারই চাবি থাকে, রাতের পরে দিন থাকে, তাই চাষা মরলেও আশা রাখে। সেই আশাতে ভর করে, মনের জানলা আমি হাট করে খুলে রেখেছি।


মন ছুঁয়ে গেল।
উত্তরমুছুনMoner janala khuley diley kato kichhu je dekha jaay..etodin samay chhilona edike takanor.. atmonimogon ta atmobismriti r dikey thele diyechhilo aamader..ei toh chhoto chhoto amulyo moni manikyo aamader ashepashe i aachhe..janala khuley dekhe naao..kuriye naao..sara jibon er sanchoy hoye thakbe..
উত্তরমুছুনCorona ke dhanyobad emon sujog deoar jonyo..aar tokey dhanyobad emon manograhee lekha upohaar deoar jonyo..
Khub bhalo laaglo..
'পরিস্কার আকাশে প্রিয় মানুষদের খোঁজ'..মন ছুঁয়ে গেল। কত অজানা আর আদেখার মাঝে আমাদের নিত্য যাপন। মনের জানালা সত্যিই খুলে গেল। আরও পড়তে চাই আপনার লেখা।
উত্তরমুছুন