মধ্যরাত, একজন কোভিড আক্রান্ত রোগী ও কিছু ভাসমান পি.পি.ই পরা অস্বচ্ছ অবয়ব
৩১ শে
জুলাই আমার জন্মদিন। সবই ঠিকঠাক ছিল সেদিনও পর্যন্ত।আমারই এক বান্ধবী কলি ঐদিনই আমায়
আমন্ত্রণ জানাল কালীঘাটের মন্দিরে যাবার। ওরা ঐ মন্দিরের সেবায়েত। এখন এই করোনার সময়ে
বাইরের লোকেদের যাওয়া নিষেধ। শুধু সেবায়েত, যারা ভোগের আয়োজন করেন তারা এবং তাদের কিছু
আত্মীয় পরিজন মায়ের দর্শন করতে পারে, ভোগ নিয়ে আসতে পারে। আনন্দে রাজি হলাম। মায়ের
জন্য কিছু প্রণামী নিয়ে রওনা দিলাম। গাড়িতে টালিগঞ্জ থেকে কালীঘাট পনেরো মিনিটের রাস্তা,
পৌঁছে গেলাম। মন্দিরের গর্ভগৃহ একদম ফাঁকা। মায়ের শরীরে হাত বুলিয়ে, শিবের পায়ে মাথা
ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম। সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত – এমনকি এত রোমাঞ্চিত যে কোন প্রার্থনা
করতেই ভুলে গেলাম। ভাবলাম ঠিকই আছে, মায়ের দর্শন পেয়েছি এটাই অনেক সৌভাগ্য। মন্দির
দালান চত্বরে একটু বসলাম – হঠাৎ বৃষ্টি এলো ঝেঁপে, যতক্ষণ না বৃষ্টি থামে বসে গল্প
করতে লাগলাম। দুপুর দু’টো বেজে গেল, মায়ের ভোগ গোছান হল, তারপর রওনা দিলাম। বৃষ্টি
একটু কমেছিল, ততক্ষণে। ওমা! ভোগ নিয়ে রওনা হতেই মুষলধারে বৃষ্টি। মন্দির চত্বর থেকে
মন্দির প্রাঙ্গণ, তারপর দোকানপাট পেরিয়ে তবে গাড়ি। চান করে গেলাম, নতুন একটা শাড়ী পরে
গেছিলাম – বৃষ্টিতে ভিজে দফা রফা। এত মেঘের ডাক, বিদ্যুতের চমক যে ভয়ে একটা দোকানে
গিয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। বৃষ্টি থামার নাম নেই, বেলা বেড়ে যাচ্ছে, কর্তামশাই
না খেয়ে বসে থাকবেন। ঐ রকম ভিজে অবস্থাতেই আরো ভিজতে ভিজতে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। বেচারী
কলিদের গাড়ীর ভেতরেও বন্যা বইতে লাগল। পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম টালিগঞ্জ।
ওমা! টালিগঞ্জে পৌঁছে দেখি রাস্তা শুকনো খটখটে। কোথাও এতটুকুও বৃষ্টি নেই। কেউ বিশ্বাসই
করল না যে কালীঘাটে বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। যাই হোক, প্রমাণ করার দরকার ছিল না – কেননা
আমার শাড়ী, আমি তখনও চুপচুপে জলে ভেজা। কর্তামশাইকে খেতে দিয়ে অল্প খেয়ে নিলাম।শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, শুয়ে পড়লাম বিছানায়। শাঁখের আওয়াজে ঘুম যখন ভাঙল, তখন সূর্যদেব পাটে
গিয়েছেন। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। প্রচন্ড জ্বরে সর্বশরীর থরথর করে কাঁপছে। জ্বরের প্রচন্ড
তাপে বালিশ-বিছানা আগুনের মত গরম। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকুও নেই। অনেক রাতে মনে হলো
কারা যেন কথাবার্তা বলছে। ছেলে অফিস থেকে ফিরে আমাদের হাউস ফিঞ্জিসিয়ান ডঃ মজুমদারকে
ডেকে এনেছে। তিনি আমায় পরীক্ষা করলেন, শ্বাস নিতে বললেন, কারণ ইতিমধ্যেই আমার শ্বাস
কষ্ট শুরু হয়ে গেছে। বুকটা হাঁপরের মত উঠছে নামছে। একটা কথাই বারবার কানে আসতে লাগল,
বড্ড দেরী করে ফেলেছেন। শ্বাসকষ্ট এত বেশী হচ্ছিল যে রাত্তিরটা বালিশে হেলান দিয়ে কেটে গেল।
পরদিন
সকালে একটু ফর্সা হয়েছে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ওমা! ইতিমধ্যেই ফ্ল্যাটে গুঞ্জন শুরু
হয়ে গেছে! আমার কোভিড হয়েছে নিশ্চয়। আমি কিন্তু এখনো swab test করাইনি। একজন তো ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে কোন এক আত্মীয়র বাড়ি রওনা হয়ে গেলেন। আমি তো স্থানুর মত, চোখে দেখছি, কানে
শুনছি, আমার করার কিছু নেই। সকাল ন’টায় কাজের লোক আসে, একজন রান্নার, একজন ঠিকে কাজের
লোক। তারা দু’জন আধ ঘন্টার আগে পরে আসে।প্রথম জন দরজায় বেল দিয়ে বাইরে থেকেই বলল, “দোতলায় বৌদির কাছে শুনলাম, আপনার করোনা হয়েছে- আমি তো এখন কাজ করতে পারব না বাবা!
যদি আমার করোনা হয়?” কোন রকমে কষ্টে সৃষ্টে উঠে তাকে বললাম, “মাসি! আমার এখনও
test হয়নি, যদি test করে করোনা ধরা পড়ে তখন নিশ্চয় তোমাকে আমি ছুটি দিয়ে দেব।“ কিন্তু
কার কথা কে শোনে! দোতলার বৌদি বলেছে! আমি যে মাসে মাসে এতগুলো টাকা দিই, দরকার অদরকারে
তোমাদের দেখি, সেটা বড় কথা নয়। বললাম, মাসি আজ এসেছ, অন্ততঃ একটু মাছের ঝোল রেঁধে দিয়ে
যাও, আমার তো উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে, গায়ে জ্বর, আমিও তো অসুস্থ্। কিন্তু সে সদর্পে
বলে উঠল “আমি ওসব মারণ রোগের শিকার হতে পারব না, খেটে খেতে হয় বৌদি, অসুস্থ হলে আমাদের
চলবে না, চিকিৎসারই বা পয়সা কোথায় আমাদের?” বলেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। মিনিট কুড়ি
বাদে দ্বিতীয়জন হাজির। বেল বাজিয়ে দরজার বাইরে থেকে বলল, “পাড়ার সবাই বলছে তোমার নাকি
করোনা (করুণা) হয়েছে? আমি বাবা কাজ করতে পারব না। যদি আমার করুণা হয়।“ আমি বললাম “মায়ের
দয়া হয় শুনেছি, মায়ের করুণা হয় কখনও শুনিনি। যাই হোক, তুই যখন এসেছিস, এঁটো বাসন কটা
মেজে দিয়ে যা।“ কিন্তু ইতিমধ্যেই তো রান্নার মাসির সাথে তার মোবাইল মারফৎ কথা হয়ে গেছে,
সেও ঐ একই কথা বলল, আমার যদি করুণা হয়? না বাবা, আমি আর তোমার বাড়ি কাজ করব না। সিঁড়ি
দিয়ে নেমে যাওয়ার পদশব্দ শুনলাম। আর আমি! সত্তর বছরের রণক্লান্ত স্বামী, আই. টি. সেক্টরে
১৩ – ১৪ ঘন্টা কাজ করা পুত্র ও দশম শ্রেণীতে পড়া আমার নাতনিকে নিয়ে অগাধ জলে পড়লাম।
একদিকে অসম্ভব মাথা যন্ত্রণা, জ্বর, অন্যদিকে মানসিক বিভ্রান্তি – এই দোটানায় অসম্ভব
অসুস্থ্ হয়ে পড়লাম। একটু বেলা বাড়তে মেডিনোভা থেকে লোক এসে আমার ‘সোয়াব’ নিয়ে গেল।
কিছু খেতে পারছি না, জলও না। সন্ধ্যে বেলায় ওরা WhatsApp এ জানান আমি কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত।
এটা শোনার পর অসম্ভব ভেঙ্গে পড়লাম। প্রথমতঃ এর চিকিৎসা নেই, হয়ত মৃত্যু অবধারিত। অসহ্য
শারীরিক কষ্ট, বিশেষতঃ শ্বাস প্রশ্বাসের। আমার স্বামী আর ছেলে সিদ্ধান্ত নিল শহরের
প্রতিষ্ঠিত এক নামী হাসপাতালে আমায় ভর্তি করে দেওয়া হবে। আমি তার কিছুই জানতাম না।
জ্বরে গা পুরে যেতে লাগল, শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম। মনে হলো মাথাটা একটা তপ্ত তাওয়ায়
রাখা। সাড়ে তিন চার জ্বর দেখল ছেলে, আমার তখন অজ্ঞানের মত অবস্থা। আর কিছু মনে নেই।
তখন গভীর রাত। আমি আর বাড়িতে নেই। খানিক জ্ঞান ফিরতে দেখি যে আমি হাসপাতালে।চারিদিকে নানা শব্দ আর আলো, তারই মধ্যে আমার হাত, পা, মুখ নানা যন্ত্রের সঙ্গে বাধা। দু’পাশে অনেক মানুষ, যাঁরা বোধয় ডাক্তার, আমার মুখের উপর ঝুঁকে আমাকে অবসার্ভ করছেন। একজন অপরজনকে জানান যে রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। একটা নল দিয়ে অক্সিজেন, অপর নল দিয়ে স্যালাইন, সারা অঙ্গে যন্ত্রের জাল বিস্তার। জ্ঞান ফিরেছে দেখে আমাকে ICU তে রেখে ডাক্তাররা চলে গেলেন। আর আমি? আত্মিয়-পরিজন-প্রিয়জন সবাইকে ছেড়ে পরে রইলাম আবছায়া ঠাণ্ডা ঘরে। আমার বুক জুড়ে ঠেলে এলো কান্নার হাহাকার। জীবনে আমি বেশী কিছু তো চাইনি, তবু জীবন জুড়ে ঈশ্বর, তুমি আমাকে পরাজয়, গ্লানি দিলে, কিছুই তো বাদ রাখলে না। অকালে অসময়ে আমার মেয়েটাকে কেড়ে নিলে, সবে মাত্র চাকরি করছিল, দু’টো পয়সার মুখ দেখছিল, ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে নিয়ে জীবনে ও তো খুশি হতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি?
রাত্রি
ক্রমশঃ ঘন থেকে গভীরতর হয়ে এলো। পাশ ফেরার উপায় নেই। শক্ত টান টান হয়ে শুয়ে প্রহর থেকে
প্রহরান্তর কাটাতে লাগলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। পাখির ডাকাডাকিতে সম্বিৎ ফিরল।
সকালের আলো ফুটেছে, চোখ ঘুরিয়ে চার পাশটা দেখলাম। রাতে বুঝতে পারিনি- আমার ঘিরে আরও
কিছু সিরিয়াস পেশেন্টও রয়েছেন ICU তে। চারপাশে হাসপাতালের চত্বরে ব্যস্ততা শুরু হয়ে
গিয়েছে, শুধু আমাদের ঘরে একটা ঠাণ্ডা শূণ্যতা। একটা বিষাদের ধোঁয়া ধোঁয়া নিঃস্তব্দতা, যেন সমস্ত ঘরে থম মেরে রয়েছে। বাইরের ব্যস্ত শহর- শহরবাসী এই হিমেল ঘরকে স্পর্শ করতে
পারে না। যখন পি.পি.ই পরা নার্স এখানে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখে গেল- যন্ত্রপাতি
চেক করল; দেখল আমি জেগে, চোখের পাতা নড়ছে। নার্স চলে গেল, পড়ে আছি হিমেল এক ঠান্ডা
ঘরে। এমনিতে আমার ঠান্ডা খুব একটা সহ্য হয় না। বাড়িতে যখন থাকি, বাইরে বৃষ্টি হলে আমার
খুব শীত করে- পাখা বন্ধ করে দিই। ওরা সব খুব রেগে যায়। সেজন্য আমার কাছে কেউ শোয় না-
বরও না, মেয়েও না। একলা শুয়ে আমি অভ্যস্ত। চারিদিকে আবছায়ায় ঘেরা, হাসপাতালের ICU বেডে
শুয়ে কত কথাই না মনে পড়ছে্, ছোট ভাইটার কথা। আমাদের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। রোজ ঝগড়া-
এমন কি মারামারিও বাদ যেত না। চুলের মুঠি ধরে পিঠে কিল বসিয়ে দেওয়া, কামড়ে দেওয়া- এসবই
ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিয়ের আগের রাতেও আমরা একসঙ্গে এক বিছানায় গলা জড়াজড়ি করে শুয়েছি।
সেদিন আর মারপিট হয় নি- রাঙাদির তো বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। বিয়ের পর ভাইটার জন্য
বড্ড মন কেমন করত, ভীষণ কান্নাকাটি করতাম। তখন এত মোবাইলের চল ছিল না, হঠাৎ হঠাৎ একেকদিন
দেখতাম আমার শ্বশুরবাড়িতে এসে হাজির। তখন আর কত বয়স, ১২-১৪ বছর। গড়িয়া তো তখন গ্রাম,
অতদূর থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, আমি তো অবাক। পেট ভরে খাইয়ে, হাতে গাড়ি ভাড়ার পয়সা
দিয়ে বুঝিয়ে, ওকে বাড়ি পাঠাতাম। এইসব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ
নার্সের ডাকে তাকালাম, ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে। ভাই এসে দাঁড়িয়ে আছে, আবছায়ায়
মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। মনটা ভরে গেল। ভাই চলে গেলে ছেলে এলো, চোখটা ফোলা ফোলা,
চুল্টা এলোমেলো, বোধহয় কান্নাকাটি করেছে, সবশেষে এলেন কর্তা মশাই। মনটা খুব বিষণ্ণ,
হয়ত খাওয়া দাওয়া করেননি, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালাম ৪৩ বছরের সম্পর্কের দিকে, শুধু নাতনিটা
এলো না। দেখা হলে ভালো লাগত।ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেল। আবার সেই ঠান্ডা নিঃস্তব্ধতা
অল্প আলোয় কাঁচের ঘেরা ঘরে, বার বারই মনে হতে লাগল আমার সেই ছোট্ট অগোছালো ফ্ল্যাটের
কথা। আমার নিজের হাতে তৈরী আমার কত চেনা, কত প্রিয়, আর গাছ গাছালিতে ভরা। প্রচন্ড রোদ্দুরে
সেখানে আলোছায়ার খেলা, বৃষ্টিতে মেঘের সঞ্চরণ, ভরা বসন্তে কোকিলের ডাক আর বসন্তবৌরির উড়ে আসা, সব কিছুই বড় পিছুটান আমার।
ক্রমপরিণতি - মরণের পরে
পরদিন
থেকে নয়, সেদিন সন্ধ্যে থেকেই প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো আমার। আমাকে ভেন্টিলেশনে
রাখা হলো। চারিদিকে যন্ত্রের জাল বিছানো। আমি জ্ঞান যে হারিয়েছিলাম এমন নয়; কেমন যেন
স্বপ্নের ঘোর। খুব কষ্ট হচ্ছে, না হচ্ছে না- কোন বোধই আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ক’দিন
এভাবে কেটে গেল জানিনা, হয়ত ইতিমধ্যেই আমার ডেথ সার্টিফিকেটও ইস্যু হয়ে গেছে। আমার
সম্বিৎ খানিকটা ফিরল তখন, যখন মনে হলো, অনেক রাতে ট্রাকে করে অসংখ্য স্তূপাকার মৃতদেহের
সঙ্গে নড়তে নড়তে আমিও চলেছি। হাত-পা প্লাস্টিকে মোড়া, শুধু হাত পা কেন, সমস্ত দেহ মাথা
সমেত প্লাস্টিকের প্যাকেটের মত মোড়া- সব বন্ধ। শুধু প্যাকেটের মধ্যে গোল গোল ছোট
ফুটো, যেখান থেকে আমি চিৎকার করে উঠলাম, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়, আমি তো বেঁচে আছি,
এখনো মরিনি। গাড়ি থামাও, আমায় নামিয়ে দাও, বাড়ি যাব।“ কিন্তু ট্রাকের ঘর্ঘর আওয়াজে
কোন শব্দই শোনা গেল না। তাছাড়া কোভিড রোগীদের মৃতদেহ তো আত্মীয় পরিজনদের হাতে দেয় না,
বিশেষ কোন জায়গায় (সম্ভবতঃ বাইপাসের ধারে ধাপার মাঠ) স্থানান্তরিত হয়। ভাবলাম নির্দিষ্ট
জায়গায় যখন আমায় নামাবে তখন না হয় জানান দেব যে, “আমি বেঁচে আছি।“ কিন্তু মানুষ ভাবে
এক, হয় আরেক। মধ্যরাত্রি, তারা ভরা কালো আকাশ, মাঝে ক্ষীণ এক ফালি চাঁদের মৃদু আলোকচ্ছটা।
শুনশান ফাঁকা রাস্তা, বেশ জোরে ট্রাক চলছে একরাশ মৃতদেহ নিয়ে। হঠাৎ রাস্তায় বাঁক নিতে
গিয়ে সামনা সামনি একটা লরি এসে পড়ল, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রাকটা অ্যাক্সিডেন্টটা
বাঁচিয়ে নিতে পারল। কিন্তু এত জোরে ঝাঁকুনিটা ঘটে গেল যে, একদম ওপরের দিকে বাঁধা প্লাস্টিকে
মোড়া আমার দেহটা ছিটকে পড়ল রাস্তার ধারে আর গড়াতে লাগল নীচের দিকে। ট্রাকটা কোন খেয়ালই
করল না যে ঝাঁকুনিতে একটা প্লাস্টিকে মোড়া দেহ গাড়ি থেকে পড়ে গেছে। গড়াতে গড়াতে গিয়ে
পড়লাম রাস্তার ধারে একটা জলা জঙ্গলপূর্ণ সরু খানায়। জল বিশেষ নেই, কাদা কাদা আর জঙ্গলে
ভরা। ভাবলাম কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় আমার জায়গা; হাত, পা, মাথা, মুখ সবই প্লাস্টিকে
মোড়া, শুধু ঐ গোল গোল ছোট ফুটো গুলো দিয়ে নিঃশব্দ অন্ধকার কালো রাত যেন আমার দিকে অবাক
হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি প্লাস্টিকে মোড়া দেহটা নিয়ে নিথর হয়ে পড়ে রইলাম সেই জলা জঙ্গলপূর্ণ
খানার মধ্যে। হঠাৎ টের পেলাম পায়ের ওপর দিয়ে একটা সরীসৃপ চলে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে
পড়ে রইলাম। খানিক বাদে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি খানার পাড়ে কোন জন্তুর চোখ জ্বলছে, বোধহয়
শিয়াল বা কোন মাংসাশী প্রাণী। সময় পেলে আমায় ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু ঈশ্বরের কি লীলা, হঠাৎ
দেখি পি.পি.ই পরা কিছু উড়ন্ত ভাসমান অবয়ব ভাসতে ভাসতে খানার পাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাদের
শরীর থেকে জোনাকির অস্বচ্ছ হাল্কা একটা আলো ফুটে বের হচ্ছে। চিৎকার করে ডাকলাম, “আমায়
এখান থেকে উদ্ধার করো!“ কিন্তু গলা দিয়ে গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ বেরোতে লাগল। বোধহয়
কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি। ক্রমশঃ ভোর হয়ে আসতে লাগল। আমার বোধহয় আর এই শরীরে
থাকা সম্ভব হলো না, এই শরীরটা থেকে বেরিয়ে এলাম। এই আমি, সেই আমি, উচ্চতা ৩ ফুট ১১
ইঞ্চি, বয়স ৬২ বছর আর এখনও নিটোল, নিভাঁজ শরীর। উচ্চতা কম বলে শরীরটা একটু ভারী হয়ে
গিয়েছিল ইদানীং। তবুও বড় প্রিয় ছিল এই শরীরটা আমার। আমার চোখ দুটো খুব বড় নয়; কিন্তু
আঁখি পল্লব আর নিবিড় চাহনি বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমার দেহাবয়ব খুবই মানানসই ছিল। আমার সেই নিটোল সৌন্দর্্য, সব ছেড়ে নিঃস্ব রিক্ত এক দীর্ঘশ্বাসের
মত বেরিয়ে এলাম। বেড়িয়ে এসে দেখি ভাসমান পি.পি.ই পরা স্বচ্ছ অবয়ব নিয়ে আমি ওদের সঙ্গে
ভাসছি আর ভাসছি। কিন্তু ভোর হয়ে আসছে, মানুষজনের চোখে ধরা পড়ে যাব, তাই আরও উঠতে লাগলাম,
ওপরে, আরও ওপরে। যেখানে মেঘের দল জমাট হয়ে থাকে, যেখানে নীলাকাশে বিন্দুর মত আমাদের
অস্তিত্ব কেউ টের পাবে না।
অতৃপ্ত আত্মা - ফিরে দেখা
দিনটা
কেটে গেল।সন্ধ্যেবেলা মনের মধ্যে বাড়ির টান যেন আকুলি বিকুলি করতে লাগল। নিজেকে সামলে
রাখলাম।রাত ঘন হতে নামতে লাগলাম, আমার কিন্তু কোন ডানা বা পাখনা নেই, নীলাকাশে পাক
খেতে খেতে নামতে লাগলাম, মনে হলো একবার আমার সবচেয়ে প্রিয় বাড়িতে যাই। কারো সঙ্গেই
তো শেষ দেখা হয়নি। সবার আগে গেলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় নাতনির কাছে। তখন অনেক রাত, ঘুমন্ত
রাত, গভীর নিদ্রায় ও ঘুমোচ্ছে। আমার মাথার বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে, হয়ত ঐ বালিশে
এখনও আমার গন্ধ লেগে রয়েছে। চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছে ঘুমন্ত অবস্থায়- আলতো করে মুছিয়ে
দিলাম, আমারও চোখের জল বাঁধ মানল না, অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। বিছানার পাশেই গোপালের সিংহাসন।
ওদের দিকে ফিরেও তাকালাম না। এত অসময়ে আমাকে তোমরা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলে কেন? কোন
অপরাধ আমি করেছি? আমার নাতনিই বা কোন অপরাধটা করেছে যে তাকে তুমি অসহায় করে দিলে? খাটের
পাশে নীচে মেঝের যে প্রিয় জায়গাটা সেখানে ঠেস দিয়ে বসে কাঁদতে লাগলাম। এই ঘর, এই বহমান
জীবন, এ বাড়ির মানুষজন, গাছপালা, একফালি আকাশ, আমি বড় ভালবাসতাম। কেন তোমরা আমাকে এসব
থেকে বঞ্চিত করলে? কি পাপ আমি করেছি? ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে আমি তাকালাম, কেউ ঠাকুরকে
ধরেনি এতদিন, অশৌচ চলছে। বাসি ফুলের মালা গলায় ঝুলছে আর বাতাসাতে পিঁপড়ে ভর্তি। বসে
বসে কাঁদতে লাগলাম। আমার তো চলে যাবার কথা ছিল না, ৫-৬ টা নতুন সিল্কের শাড়ি, পরা হল
না। সেনকো গোল্ড থেকে সদ্য বানানো নেকলেস পড়ে রইল। একদিনও অঙ্গে তুললাম না। অজস্র না
পাওয়ার বেদনা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। আর আমি কাঁদতে লাগলাম অঝোরে, বাঁধন ছেঁড়ার
সময় বোধহয় এগিয়ে আসছে। অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায় নিজেকে শান্ত করলাম। নাতনির কপালে
আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে এলাম। পাশের ঘরে কর্তা মশাই, আমার তেতাল্লিশ বছরের সঙ্গী,
দেখলাম বেচারীর চোখে ঘুম নেই, এপাশ ওপাশ করছে। পায়ে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করলাম, বেচারী
বড্ড একলা হয়ে গেল। হয়ত কাজের লোক রান্না করে দেবে, চা করে দেবে কিন্তু টাকা গুনে দেবে
কে? যখন বেশী টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনত, তখনই ও গুণতে গুণতে নাজেহাল হয়ে যেত। মেলাতে
পারত না। ডাক পরত আমার। আমি এসে গুণে দিলে নিশ্চিন্ত হয়ে আলমারিতে তুলে রাখত। এখন এসব
ওকে একাই করতে হবে। বড় নির্ভরশীল ছিল মানুষটা। আর আমি সেটা খুব প্রশ্রয় দিতাম। এই গোটা
লকডাউন জুড়ে একটুও বিশ্রাম পাইনি। মোচা, কচুর ঘন্ট, পুঁই শাক দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা,
ভাপা ইলিশ, পাঁঠার মাংস, মুরগীর কষা, এসবই নির্বিবাদে রান্না করেছি, খেয়েছি এবং খাইয়েওছি।
এবার কী হবে? ওরকম রান্নার লোক পাবে? অবশ্য আমি তো এখন অশরীরী, আত্মা, এই পিছুটান আমাকে
কাটাতেই হবে। চলে এলাম ঘর থেকে, আসার সময় দেখলাম সদ্য পেরিয়ে যাওয়া বিবাহ বার্ষিকীর
ছবিটাতে মালা দেওয়া। ডুকরে কান্না উঠে এলো বুক থেকে। কোনদিন ভেবেছিলাম আমার ছবির গলায়
মালা ঝুলবে, আর আমি তা দেখব! হা ঈশ্বর!
যাবার
আগে মনে হলো নীচে, একতলায় ছেলের ঘরে একবার যাই। আর তো কোনদিন আসব না। নীচে গেলাম, অল্প
নীল আলো জ্বলা ঘরে ছেলে ঘুমোচ্ছে। বেচারী বউ-বাচ্চাকে ছেড়ে বড় একলা হয়ে গেছে। দেখলাম
ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করে কী যেন বলছে, হয়ত বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে স্বপ্নে কথা বলছে।
খালি গায়ে শুয়ে। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম, কপালে একটা চুমু খেলাম। এবারে মা তো আর
রইল না, বউ-বাচ্চাকে নিয়ে এসে সুখে সংসার কর। পারলে বাবাকে একটু দেখিস। দিদিভাই এর
মা মরা মেয়েটা রইল, তাকেও দেখিস, বিয়ে থা দিস, ওর গয়না, পড়াশোনার খরচ, বিয়ের খরচ সব
আলাদা আলাদা হিসেব করে রেখে দিয়েছি, সময় মত ব্যবহার করিস। দুঃখ করিস না তোকে একলা ফেলে
গেলাম বলে, আমার তো কোনো উপায় নেই বাবু। আমি তো যেতে চাই নি। ঝরঝর করে একরাশ চোখের
জল নিয়ে বিদায় নিলাম এই প্রিয়জনদের কাছ থেকে, এই নিজের গড়ে তোলা সংসার থেকে।
আত্মা অবিনশ্বর
বাতাসে
ভাসমান আমি পিপিই পরা অস্বচ্ছ অবয়ব নিয়ে পাক খেতে খেতে চলে গেলাম অনেক উঁচুতে। দক্ষিণ মেরু ছাড়িয়ে উত্তর
মেরুর দিকে, বিষুব রেখা পেরিয়ে, অক্ষরেখা অতিক্রম করে আরও দূরে, বহুদূরে। চোখ এখনও
ঝাপসা হয়ে আসছে; জলে ভরে উঠছে মাঝে মাঝে। কতক্ষণ এভাবে চলেছি জানিনা হঠাৎ শীত করতে,
বুঝলাম পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে এসে পৌঁছেছি। চারিদিকে অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, আমাদের পৃথিবীটা
সুন্দর ঠিকই, কিন্তু এতো আরো সুন্দর অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য ভরা জগৎ। দেখে মনটা একটু
শান্ত হল। হয়ত একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ দেখি আমার মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বাপি এক গাল হাসি নিয়ে অদূরেই দাঁড়িয়ে।
বলল, “দুঃখ করিস না, আমরা তো আছি, এক ভালোবাসার পৃথিবী থেকে এ এক ভালোবাসার অন্য ভুবন।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। অবাক হয়ে গেলাম তখন যখন পেছন থেকে কে একজন আমার চোখ টিপে ধরেছে।
জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিতেই দেখি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরলাম; ভগবান এই বন্ধন
যেন কোনদিন ছিন্ন না হয়।
ভালো লাগলো না।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো না
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লাগলো। জীবনকে পেছনে ফেলে আসার পরে যে অভিব্যাক্তি তা এককথায় অপূর্ব!!
উত্তরমুছুন