অসহায়
২০/১০/২০২০
সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়*
পৃথিবীটা আজ যেন থমকে আছে। বিশ্বব্যাপী অতিমারির প্রকোপ আমাদের দাঁড় করিয়েছে এক অদ্ভুত বাস্তবের মুখোমুখি। কল্পনা কখনো কখনো বাস্তবে রূপায়িত হয় ঠিকই কিন্তু এ এমন এক বাস্তব যা কোনদিন কল্পনায় স্থান পায় নি। সারা বিশ্বের আপামর মানুষ আজ ভয়ে জড়সড় হয়ে সেঁধিয়ে আছে নিজের ঘরে। চারিদিকে শুধু একটাই শব্দ - নেই। মানুষের হাতে কাজ - নেই, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিত্যসামগ্রীর যোগান - নেই, সংসার চালানোর জন্য প্রয়োজন যেটুকু - নেই, সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার - নেই, রাস্তাঘাটে পর্যাপ্ত যানবাহন - নেই, ওষুধের নিয়মিত সরবরাহ - নেই, হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ambulance - নেই, হাসপাতালে চিকিৎসার পরিকাঠামো - নেই, মানুষের জন্য মানুষের সহমর্মিতা - নেই; এমন কি এই দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চোখের সামনে কোন উপায় - তাও নেই। নেই রাজ্যের এই অনিশ্চয়তা ক্রমশঃ অসহিষ্ণু করে তুলছে আমাদের, কারণ এতকিছু “নেই” এর সাথে বেঁচে থাকতে আমরা অভ্যস্ত নই।
অনেকে বলছেন এই ধরণের অতিমারি পৃথিবী আগেও দেখেছে, কেউ বলছেন প্রকৃতির উপর মানুষের সীমাহীন অত্যাচারের করুণ পরিণতি এই অতিমারি, কেউ বলছেন প্রকৃতি তার বিপন্ন অস্তিত্বকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হয়তো বা সবটাই ঠিক। তবে এ কথা ঠিক, এই পৃথিবীতে এখন যারা জীবিত আছেন তাদের মধ্যে কেউ এমন অতিমারি চাক্ষুষ করেননি। আবার এটাও ঠিক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক মানুষ ছড়িয়ে আছেন যারা ‘নেই’ এর রাজ্যেই বেঁচে থাকেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর এই বেঁচে থাকা অতিমারির জন্য নয় এটাই তাদের ভবিতব্য। আমাদের ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে না পেরে, বন্ধুদের সান্নিধ্য না পেয়ে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এমন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, স্কুলে যাওয়াটাই যাদের কাছে বিলাসীতা। আজকের এই অতিমারি তাদের নতুন করে পিছিয়ে দিতে পারে নি। অসুখ বিসুখ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা এসবে চিকিৎসা না পাওয়া এবং চোখের সামনে প্রিয়জনকে চলে যেতে দেখা, তাদের মনে রেখাপাত করে না কারণ প্রতিনিয়ত এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে তারা অভ্যস্ত। এমনই কিছু মানুষের কথা এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করব যাদের রোজকার জীবনের সংগ্রামের কাহিনী আমাদের এই তাৎক্ষণিক অতিমারির ভয়াবহতাকে একেবারে তুচ্ছ প্রমাণ করার ক্ষমতা রাখে।
সমুদ্র দিয়ে শুরু করা যাক। আরব সাগরের বুকে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার নিয়ে জেগে থাকা প্রবালের স্বর্গ লাক্ষাদ্বীপ। মালদ্বীপ থেকে আসা ইসলাম সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে বাস করেন। যারা প্রধানতঃ 'মাল' ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। সমগ্র দ্বীপপুঞ্জের মাত্র কয়েকটি মানুষের বাসযোগ্য। মিনিকয় তাদের মধ্যে অন্যতম। এই দ্বীপের লোকসংখ্যা অন্য দ্বীপগুলোর তুলনায় একটু বেশি। তবে নোনা মাটি, কাদা জল আর অসংখ্য নারকেল গাছে ঘেরা এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবন যথেষ্ট কঠিন। প্রধানতঃ পর্যটন আর কিছু কুটীর শিল্প এই দ্বীপের মানুষগুলোর জীবনধারণের অবলম্বন। পর্যটকদের জন্য লাক্ষাদ্বীপের চারদিনের ভ্রমণসূচীতে মিনিকয় আমাদের শেষ গন্তব্য। সারাদিন ঘোরাফেরার পর আমাদের ছোট নৌকা সমুদ্রে ভাসল। আমাদের জাহাজ সমুদ্রের বেশ খানিকটা ভিতরে নোঙর করেছে। তাই উত্তাল সমুদ্রে এই ছোট্ট নৌকাতেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে।

অনেকে বলছেন এই ধরণের অতিমারি পৃথিবী আগেও দেখেছে, কেউ বলছেন প্রকৃতির উপর মানুষের সীমাহীন অত্যাচারের করুণ পরিণতি এই অতিমারি, কেউ বলছেন প্রকৃতি তার বিপন্ন অস্তিত্বকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হয়তো বা সবটাই ঠিক। তবে এ কথা ঠিক, এই পৃথিবীতে এখন যারা জীবিত আছেন তাদের মধ্যে কেউ এমন অতিমারি চাক্ষুষ করেননি। আবার এটাও ঠিক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক মানুষ ছড়িয়ে আছেন যারা ‘নেই’ এর রাজ্যেই বেঁচে থাকেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর এই বেঁচে থাকা অতিমারির জন্য নয় এটাই তাদের ভবিতব্য। আমাদের ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে না পেরে, বন্ধুদের সান্নিধ্য না পেয়ে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এমন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, স্কুলে যাওয়াটাই যাদের কাছে বিলাসীতা। আজকের এই অতিমারি তাদের নতুন করে পিছিয়ে দিতে পারে নি। অসুখ বিসুখ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা এসবে চিকিৎসা না পাওয়া এবং চোখের সামনে প্রিয়জনকে চলে যেতে দেখা, তাদের মনে রেখাপাত করে না কারণ প্রতিনিয়ত এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে তারা অভ্যস্ত। এমনই কিছু মানুষের কথা এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করব যাদের রোজকার জীবনের সংগ্রামের কাহিনী আমাদের এই তাৎক্ষণিক অতিমারির ভয়াবহতাকে একেবারে তুচ্ছ প্রমাণ করার ক্ষমতা রাখে।
সমুদ্র দিয়ে শুরু করা যাক। আরব সাগরের বুকে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার নিয়ে জেগে থাকা প্রবালের স্বর্গ লাক্ষাদ্বীপ। মালদ্বীপ থেকে আসা ইসলাম সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে বাস করেন। যারা প্রধানতঃ 'মাল' ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। সমগ্র দ্বীপপুঞ্জের মাত্র কয়েকটি মানুষের বাসযোগ্য। মিনিকয় তাদের মধ্যে অন্যতম। এই দ্বীপের লোকসংখ্যা অন্য দ্বীপগুলোর তুলনায় একটু বেশি। তবে নোনা মাটি, কাদা জল আর অসংখ্য নারকেল গাছে ঘেরা এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবন যথেষ্ট কঠিন। প্রধানতঃ পর্যটন আর কিছু কুটীর শিল্প এই দ্বীপের মানুষগুলোর জীবনধারণের অবলম্বন। পর্যটকদের জন্য লাক্ষাদ্বীপের চারদিনের ভ্রমণসূচীতে মিনিকয় আমাদের শেষ গন্তব্য। সারাদিন ঘোরাফেরার পর আমাদের ছোট নৌকা সমুদ্রে ভাসল। আমাদের জাহাজ সমুদ্রের বেশ খানিকটা ভিতরে নোঙর করেছে। তাই উত্তাল সমুদ্রে এই ছোট্ট নৌকাতেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে।
মিনিকয় লাইট হাউস
উত্তাল সমুদ্রের বুকে মিনিকয়
সমুদ্রের ঢেউয়ে নৌকাটা যেন মোচার খোলার মত উঠছে আরে নামছে। ঘন নীল সমুদ্রের বুকে সূর্য্যাস্ত দেখছিলাম। চোখ আঁটকে গেল নৌকার একদম ধারে বসে থাকা অসুস্থ একজন মহিলার দিকে। ইনি মিনিকয় দ্বীপের বাসিন্দা। দেখে এতটাই অসুস্থ মনে হচ্ছিল, বাধ্য হয়ে ওনার সাথে থাকা আর একজন মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম। জানতে পারলাম অসুস্থ ওই মহিলা আসন্ন-প্রসবা এবং সেই জন্য তাঁকে শহরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শহর, মানে যেখানে পৌঁছতে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা সময় লাগবে। নৌকার প্রবল ওঠানামায় আমরা সুস্থ লোকগুলোই অসুস্থ বোধ করছি, তার মধ্যে ওই একরত্তি আসন্ন প্রসবার কষ্ট যে কি অসহনীয় তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ক্রমশঃ যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে মেয়েটি। পরিবারের সবার উৎকণ্ঠা নৌকায় বসে থাকা মানুষগুলোকেও অস্থির করে তুলেছে। এভাবে প্রায় আধঘন্টা ধরে ভেসে চলল আমাদের নৌকা। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের জাহাজটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েটির পরিবারের লোকজন সেটা দেখিয়ে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও চোখ মেলে দেখার মত জীবনীশক্তি তার অবশিষ্ট নেই। কি চরম অসহায়তা। একটি প্রাণকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে বেচারির নিজের প্রাণটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অবশেষে আমাদের নৌকা জাহাজের কাছে পৌঁছল। নৌকার পাটাতন থেকে জাহাজের পাটাতনের ফারাক প্রায় ফুট ছয়েক হবে। সাধারণ যাত্রীরা সবাই জাহাজের নাবিকদের সহায়তায় জলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে জাহাজের পাটাতনে পা রাখলেন। কিন্তু ওই মেয়েটি? তার শরীরে যে একফোঁটা শক্তি নেই, এই উচ্চতার ফারাক মিটিয়ে কিভাবে জাহাজে উঠবে বেচারি? জাহাজের নাবিক আর তার পরিবারের লোকজনের কাছে এ এক কঠিন পরীক্ষা। আমার সহযাত্রীরা সবাই জলের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে যে যার কেবিনে চলে গেছেন। কেন জানিনা আমি যেতে পারিনি। কষ্টে কালো হয়ে যাওয়া মেয়েটির মুখটা আমা্কে যেন আটকে রেখেছিল। নৌকার দুজন মাঝি একটি কাঠের পাটার উপর মেয়েটিকে শুইয়ে দিল। হাত আর পা দুটো বেঁধে দিল শক্ত দড়ি দিয়ে। পাটায় শুয়ে থাকা মেয়েটাকে মাঝিরা তুলে ধরেছে তাদের বুকের কাছে। জাহাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন চারজন নাবিক। জলের প্রবল ধাক্কায় নৌকাটা উঠছে আর নামছে। এভাবে ওঠানামা করতে করতে দুটো পাটাতনের দুরত্ব যখন সবচেয়ে কম হল, মাঝিরা ঠেলে তুলে দিল মেয়েটি সমেত পাটা। জাহাজে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন নাবিক অত্যন্ত নিপুণতার সাথে প্রায় বুকে টেনে নিল পাটায় বাঁধা মেয়েটিকে। ক্ষণিকের জন্য আমার চোখ বুজে গিয়েছিল। বুকটা যেন হাঁপড়ের মত ওঠানামা করছে মেয়েটির। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের ফারাক দেখলাম। দুই দলের কোন একজন মানুষের এতটুকু সমন্বয়ের অভাব হলে নিশ্চিতভাবে মেয়েটি সমেত পাটাটা পড়ে যেত গভীর সমুদ্রে। নাবিকরা ছুটোছুটি করে মেয়েটিকে নিয়ে গেল জাহাজের ডেক এ। নিত্য যাতায়াতের জন্য স্থানীয় মানুষদের ডেকেই সংরক্ষণ দেওয়া হয়। হাত-পা এর বাঁধন খুলে দিতেই মেয়েটির শরীরটা কেমন এলিয়ে গেল। পরিবারের লোকজন স্তম্ভিত। একটু পরে চোখ মেলে চাইল মেয়েটি। যাক এ যাত্রায় উতরে গেল। আমিও কেবিনে চলে গেলাম। কিন্তু মনটা বড় অস্থির লাগছিল। কেবিনের জানলা দিয়ে জ্যোতস্নাস্নাত সমুদ্র দেখছিলাম বটে, কিন্তু যেন ঠিক উপভোগ করতে পারছিলাম না। বেড়িয়ে পড়লাম। তিনতলার সিঁড়ি ভেঙ্গে গেলাম ডেক এ। দেখলাম ডেক এর দরজার সামনে মেয়েটির পরিবারের একজন দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম মেয়েটির কথা। শুনতে পেলাম এই দ্বীপের মানুষের জীবন-সংগ্রামের কাহিনী। মিনিকয় দ্বীপে একটি মাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে যেখানে সপ্তাহে দুদিন ডাক্তার আসেন। সমস্ত দ্বীপগুলির সাথে ভূমির যোগাযোগ বলতে কেরালার কোচি বন্দর। সেখান থেকে যে জাহাজ ছাড়ে, অন্যান্য দ্বীপ ঘুরে তা মিনিকয়ে পৌঁছায় তিনদিন পর। তাই শহর থেকে আসা ডাক্তার সপ্তাহে দুদিনের বেশী আসতে পারেন না। আর এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাধারণ জ্বর সর্দিকাশি জাতীয় অসুখ ছাড়া চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। সুতরাং চিকিৎসার জন্য শহরে যাওয়া বাধ্যতামূলক আর সেই জন্য রোগীকে তার রোগের যন্ত্রণা ভুলে এই কঠিন অসম যুদ্ধ করতে হয় উত্তাল সমূদ্রের সাথে। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম ভদ্রলোকের কথা। মিনিকয় দ্বীপের মানুষের দুর্দশার কাহিনী। গ্রামের প্রবীণ মানুষদের কঠিন অসুখ হলে এ দ্বীপের মানুষ মন শক্ত রাখে। এ কঠিন যুদ্ধ কোন প্রবীণ মানুষের পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। তাই কতকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকে এখানকার মানুষ। দুর্দশার এখানেই শেষ নয়। প্রতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর জাহাজ পরিষেবা বন্ধ থাকে। এই সময় কোন মানুষ অসুস্থ হলে তার মৃত্যু অনিবার্য। কপালের জোর খুব বেশি থাকলে কখনো কখনো পর্যটকদের নিয়ে আসা হেলিকপ্টারের সাহায্য মেলে। সমুদ্রের নোনা জল, বালি আর দ্বীপে জন্মানো কিছু ভেষজ উদ্ভিদের ভরসাতেই এই দ্বীপে বাস করে কয়েক হাজার মানুষ। আর এই দ্বীপের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে সারা বছর দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসেন যাঁরা রোদ চশমা পরে রোদের উত্তাপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে বড় ছাতা খুলে সৈকতে বসে উপভোগ করেন সবুজ সমুদ্র। মন মানল না। চলে গেলাম মেয়েটির কাছে। আধ বোজা চোখ, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে বার বার বমি করে করে। হাতের আঙুল গুলো কাঁপছে। পরনের হলুদ জামাটা ভিজে গিয়ে তার রঙ বদলে ফেলেছে। এক চামচ করে জল মুখে দিচ্ছেন এক মহিলা আর ওড়না দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছেন মেয়েটির মুখ। মেয়েটির দু'চোখ বেয়ে অঝোরে বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা তার কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। কাছে গিয়ে মেয়েটির গায়ে হাত রাখলাম, মনে হল কোন পাথরে হাত রেখেছি। বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। মা হওয়া যে সত্যিই মুখের কথা নয়, তা যুগে যুগে এভাবেই প্রমাণ করে চলেছে মহামায়ার হাজার হাজার সন্তান। কেবিনের ভিতরের বিলাসবহুল ব্যবস্থার মধ্যে সারারাত বসে বসে ভাবলাম জীবন সংগ্রাম কত কঠিন হতে পারে। আর সমুদ্র দেবতার কাছে মিনতি জানালাম তোমার কোলে বড় হয়ে ওঠা এই মা যেন তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারে। পরদিন প্রায় সকাল দশটা নাগাদ জাহাজ পৌঁছল কোচি বন্দরে। সমস্ত যাত্রীর আগে মেয়েটিকে নামানোর ব্যবস্থা করেছে জাহাজ কর্তৃপক্ষ। আমি ডেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। মেয়েটি স্ট্রেচারে শুয়ে আছে, একেবারে নিস্তেজ। পরিবারের লোকজনের মুখ থমথমে। দেখে বোঝা যাচ্ছে না প্রাণের স্পন্দন আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে বা আর আদৌ আছে কিনা। জাহাজের একেবারে লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ambulance। আমার মত জাহাজের অনেক যাত্রীই চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়েটি তার এই সংগ্রামে জিতল কিনা তা জানার কোন উপায় আমার নেই। কিন্তু মনে মনে কুর্ণিশ জানালাম আমার দেশমাতৃকার এই বীরাঙ্গনাকে।
এবার আসি পাহাড়ের কথায়। হিমাচলের পাব্বার উপত্যকা ধীরে ধীরে পর্যটকদের নজরে আসছে। হিমাচল প্রদেশে যত আপেল উৎপাদন হয়, তার ৭৫ শতাংশ আসে এই পাব্বার উপত্যকা থেকে। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এই পাব্বার উপত্যকায় হিমাচল প্রদেশের তথা ভারত ভুখন্ডের শেষ গ্রাম কোয়ার। এই গ্রামের ২০ কিলোমিটার আগের গ্রাম দোদরা। দোদরার পরে আর বড় গাড়ি চলার উপযোগী রাস্তা নেই। দুটি গ্রাম পৃথক দুটি পাহাড়ে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তাই সরকারি খাতায় গ্রামটির নাম দোদরা-কোয়ার। এখানে পৌঁছতে হলে ১৩,৯২৬ ফুট উচ্চতার চানসাল পাস পার হতে হয়, যা বছরে প্রায় ছ’মাস বরফে ঢাকা থাকে। কোয়ারের প্রাকৃতিক শোভা দেখে একে স্বর্গের একটি অংশ ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।
কোয়ার গ্রামের পাহাড়ি উপত্যকা
কোয়ার গ্রামের অধিবাসীরা বহু প্রাচীন হিমাচলী সংস্কৃতির ইতিহাস বহন করেন। বর্তমানে দু একজন পর্যটক আসায় দু’একটা বাড়িতে অতিথি আবাস তৈরী হয়েছে। কিন্তু আজও রক্ষণশীল এই কোয়ারবাসী বাইরের লোককে ঢুকতে দেন না তাদের আরাধ্য দেবতার মন্দিরে। দোদরা থেকে কোয়ার যাবার রাস্তা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং মাত্র চারজন বহনকারী ছোট গাড়ি বহু সময় নিয়ে অতিক্রম করে ২০ কিলোমিটার রাস্তা। দোদরা গ্রামের নিকটতম শহর রহরু, যার দুরত্ব ৪০ কিলোমিটার এবং সেখানে যেতে চানসাল পাস পার হয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ দোদরা-কোয়ার হিমাচল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। আপেলের ব্যবসার কল্যাণে এই গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ নয়। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছাড়া সরকারি পরিষেবা আর কিছুই নেই।কোয়ার গ্রামের মন্দির
রহরু থেকে দিনে একটি সরকারি বাস দোদরা পর্যন্ত আসে, তাও মাঝে মাঝেই যাত্রীদের নিরাশ হতে হয়। গাড়ি আমাদের যেখানে ছেড়ে দিল সেখান থেকে গ্রামে ঢোকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। চারিদিকের ফুল আর আপেল গাছের শোভা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি আমরা। গ্রামে ঢোকার মুখে দেখলাম কয়েকজন মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবলাম আমরা বাইরে থেকে এসেছি, বোধহয় কিছু জিজ্ঞাসা করবে। একটি বাড়ি থেকে কয়েকজন মানুষ বেরিয়ে আসছেন তাদের প্রত্যেকের চোখে জল। মহিলারা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। বুঝলাম বাড়িটিতে কোন অঘটন ঘটেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবে গ্রামে ঢুকলাম আর কোন পরিবারের সঙ্গে এমন অঘটন ঘটল। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাড়িটি থেকে আরো অনেক মানুষ বেরিয়ে আসছেন, বাইরে এসে জড়ো হচ্ছেন। আমরা অপেক্ষায় আছি শেষ ব্যক্তির বাইরে আসার। হঠাৎ দেখলাম বছর কুড়ির একটি মেয়ে দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসছে। পায়ে তার এতটুকু বল নেই। পা দু’টো ঝুলতে ঝুলতে ধাক্কা খাচ্ছে রাস্তার পাথরে। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে পরনের জামাটা। তীব্র যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে মুখটা। আমাদের অতিথিশালার মালিক অশোককে জিজ্ঞাসা করলাম মেয়েটির কি হয়েছে? বলল কিছুক্ষণ আগে সন্তান প্রসব করার পরেই মেয়েটি সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। শহর? মানে রহরু? এই অবস্থায়!! কিভাবে নিয়ে যাবে? অশোক বলল আপনারা যে গাড়িটায় এসেছেন সেটাতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সে তো এক কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে! এতটা রাস্তা এইভাবে যাবে মেয়েটি! অশোকের সটান উত্তর, এ আর নতুন কি? আজ আপনারা এলেন তাই গাড়িটা জুটল। না হলে বাঁশে হাতপা বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। বছরে ছ’মাস তো আমরা ঘরে বসেই মরি। কি শুনছি আমি! ভারতবর্ষ, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র, সেখানে জনগণনায়কের কি দুর্বিষহ বেঁচে থাকা! ধীরে ধীরে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল মেয়েটি। মুখটার দিকে যেন তাকানো যায় না। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটির চলার রাস্তায়। চোখ ফেরাতেই যা দেখলাম তাতে আমি আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। রাস্তার ধারে একটা পাথরে বসে পড়লাম। মেয়েটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন এক ভদ্রলোক। তাঁর হাতে ধবধবে সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক মোড়া মেয়েটির সদ্যজাত নিষ্প্রাণ সন্তান। রাস্তার মোড়ে এসে দুজনার পথ আলাদা হয়ে গেল। একবার চোখের দেখাও দেখতে পেরেছে কিনা জানিনা, সারা জীবনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল মা আর ছা‘র। আমার গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে আসতে লাগল। পরিবারের সদস্যরা এতক্ষণ গলা চেপে কাঁদছিলেন। গাড়িটা ছেড়ে চলে যেতেই তাদের হাহাকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে। আমার গলার কাছে দলা পাকানো কান্না সেই হাহাকারের আড়ালে মিলিয়ে গেল। ছোট্ট একটা অভিব্যাক্তি নিভৃতে বেরিয়ে এল - হা ঈশ্বর! আমরা আজ অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি । সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। তবু একেবারে থমকে যাওয়া থেকে ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার প্রয়াস আমাদের চলছে। এই অতিমারি কে জীবনের অঙ্গ হিসেবে ভাবতে পারার মত মনের জোর আমরা সঞ্চয় করতে পেরেছি। অনেক পরিচিত মানুষ, বিখ্যাত মানুষ , আত্মীয় পরিজনকে ইতিমধ্যে আমরা হারিয়েছি যাদের এত তাড়াতাড়ি হারানোর কথা হয় তো ছিল না। পরিস্থিতির চাপে এসব মেনে নেওয়ার মত মনোবল আজ আমাদের হয়েছে। মনের কোন এক কোণে ছোট্ট একটা রেখার মত হলেও আশা কিন্তু আছে যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের জোর বাড়ানোর জন্য এখন আমরা বেশি করে ধর্মকথা পড়ি, মনীষীদের বাণী পড়ি, সীমান্ত রক্ষীদের কথা ভাবি, পর্বতারোহীদের কথা ভাবি। নিরন্তর খোঁজ রাখি কবে, কোন দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। কিন্তু প্রত্যয় আমাদের আছে যে একদিন এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু যাদের কথা বললাম, তাদের মনে এই আশার আলোক রেখাটুকুও যে নেই! যুগ যুগ ধরে একই অবস্থার মধ্যে বেঁচে থাকতে থাকতে অন্যরকম বাঁচার কথা তো তারা কল্পনাও করতে পারে না। প্রকৃতির কোলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকতে থাকতে শুধু মেনে নেওয়াটাই যেন তাদের ভাগ্যলিখন। শহর থেকে দূরে প্রত্যন্ত বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বাস করা এই মানুষগুলো খাতায় কলমে আসলে শুধু জনসংখ্যা। তাদের জন্য ভাববার অবসর আমাদের কারো নেই। এই মানুষ গুলোর সুখ, দুঃখ স্বপ্ন সব কিছু আমাদের গোচরের বাইরে। আমরা জানিও না, জানার চেষ্টাও করি না। তবে আজ বোধহয় পাশার দান উলটো। আজ আমাদের শেখার সময় এসেছে। সমস্ত জৈবিক প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত স্বাভাবিক একজন মানুষ কে যদি বোতলে বন্দী করে রাখা যায় তাহলে তার কি নির্মম দূর্দশা হতে পারে তা এতদিন এই মানুষ গুলো দেখেছে আর নির্বিকার থেকেছে। আজ আমাদের তা দেখার সময়। এই অতিমারির অসহায়তা এই মানুষগুলোর জীবন সংগ্রামের সমুদ্রে এক কাপ জলের মত। যোগ বিয়োগের ফল একই থাকে। কিন্তু আমরা আজ বড় অসহায়। ‘নেই’ বলে যে ওদের কিছু নেই, অন্তত থাকবার উপায় নেই। আজ আমাদের শিক্ষাগুরু হিসেবে আমাদের সামনে আছে এই মানুষগুলো যাদের সব আছে। নাই বা থাকল ভালো রাস্তা, নাই বা থাকল ভালো পরিবহন, নাই বা থাকল ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা তবু ওদের যা আছে তা শত প্রচেষ্টাতেও আমাদের ঝুলিতে থাকবে না। ওদের মুক্ত আকাশ আছে, শুদ্ধ বায়ু আছে। নিজের মুখটুকু খুলে রাখার স্বাধীনতা আছে। প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার, পাড়া পড়শির পাশে থাকার, খেলার ছলে মাটি মাখার, সবকিছু কে ছুঁয়ে দেখার অনুমতি আছে। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ, ওদের করে তোলে লৌহমানব। এই অতিমারির সাধ্য কি তাদের জীবনে প্রভাব ফেলার! তাই আজ ওরা ভাল আছে। যা ওদের ছিল না তা আজও নেই, থাকার প্রত্যাশাও তারা করে না। ওদের একমুখ হাসি আছে, একবুক স্বপ্ন আছে আর আছে বৃত্তাকার খোলা আকাশ। চার দেওয়ালে আঁটকে থেকে, দুঃস্বপ্নের বেড়াজালে, বুকের উপর পাথর রেখে কোন রকমে না মরে বেঁচে আছি আমরা। তাই ওরা নয় আজ আমরাই বড় অসহায়।
*অধ্যক্ষা, নরসিংহ দত্ত কলেজ, হাওড়া
Dekhi aamra sabai kintu taate aamader mon thakena ..shudhu chokh bulano hot...arthyat aamra parjyobekhshon korina..
উত্তরমুছুনDekha o moner ei melbandhan ei lekhar modhye pelam..
Khub bhalo laaglo..ashadharon anubhuti..