মূর্তিনদী আর গরুমারা অভয়ারণ্য



২০/১০/২০১৯


ড. শারদা মণ্ডল* 


পরিবারের সবাই মিলে ডুয়ার্স বেড়াতে এসেছি। সময়টা ডিসেম্বরের শেষার্ধ। শীত অসহনীয় নয়। বেশ উপভোগ্য। মূর্তিনদীর ধারে রিসর্টে থাকব তিনদিন। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বনবিভাগের কর্মীরা একে একে কুনকি হাতিদের নিয়ে আসছেন নদীতে স্নান করাবেন বলে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে কন্যাসহ দৌড় লাগাই। হাতিদের জলকেলি এতকাল কেবল সিনেমা কিংবা টিভিতেই দেখেছি। সামনে থেকে এমন দৃশ্য উপভোগের সুযোগ কি ছাড়া যায়? কিন্তু নদীর কাছে যেতেই গজরাজেরা শুধু শুঁড়ের মুখটা জলের উপরে রেখে বাকি শরীরটা জলের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। বনবিভাগের কর্মীরা সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, আমরা যেন সরে যাই। হাতিরা লজ্জা পাচ্ছে। সত্যিই তো আমরা মানুষেরা কি স্বার্থপর! শুধু নিজেদের উল্লাসকে এতটা গুরুত্ব দিই, যে অন্যের পছন্দ অপছন্দগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনা। সে হোক না মানুষ ছাড়া অন্য কেউ, কারোর একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে অনধিকার প্রবেশ করতে নেই। নিজেরাই খুব লজ্জিত হলাম।

নগাধিপতি হিমালয়। তার পাদদেশে ডুয়ার্সের প্রকৃতি যে এত সুন্দর, যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ঢেউ খেলানো জমিতে চা বাগান, মধ্যে মধ্যে কাঁচা মাটির পথ, ছোট ছোট গ্রাম, আর তরাইয়ের জঙ্গল। নীল আকাশ ঝুঁকে পড়ে সবুজ চা বাগানের সঙ্গে কত কী কথা বলে। হাওয়ায় কান পাতলে শোনা যায়। কলেজ থেকে যত বার এদিকে ফিল্ড সার্ভেতে এসেছি, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে, আকাশ সব সময় মেঘে ঢাকা পেয়েছি। লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ গেলাম দুবার। চারিপাশ শুধু সাদা, হিমালয়ের শ্রেণী দেখা তো দূর, নিজেকে দেখা দায়। সেবার পেলিং গিয়েও একই দশা। পর্বত দুহিতা উমা তো আমাদের ঘরের মানুষ, আমাদের মা। তাই গিরিরাজ আমার একরকম অভিভাবকও বটে। তাই মাতামহের ওপরে খুব অভিমান হয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম এতই যদি আড়াল রাখবে, আর তোমার কাছে আসবো না। এবারে কর্তা যখন স্থির করলেন, গন্তব্য পূর্ব হিমালয়, তখন মুখ ভার করেছিলাম। পরে তাঁর মন রাখতে নিমরাজি হলাম। 



                                                ডুয়ার্সের পটভূমিকায় গিরিরাজ হিমালয় 

এখানে এসে বুঝলাম, না এলে অনেক কিছুই হারাতাম। নীল আকাশে মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। যেখান থেকেই উত্তরে তাকাই না কেন, নীল পর্দার সামনে ঝকঝকে গিরিশ্রেণী, মাথায় হীরের মুকুট। এতটুকু আড়াল নেই। মাতামহ আমার সব অভিমান মূর্তি নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। মূর্তি থেকে একটু এগোলে চালসা। এখানে আমি দু দুবার ভূগোলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ফিল্ড সার্ভে করেছি। অপূর্ব দৃশ্যপট, চোখ ফেরানো যায় না। এখানকার টিয়াবনের জঙ্গলের ধারে বেশির ভাগ হোটেল রিসর্টগুলো আছে। জঙ্গল খুব ঘন নয়। সূর্যের আলো ঢোকে। সবচেয়ে ওপরের সারির গাছেরা সরলবর্গীয় ও দীর্ঘকায়। তাদের গায়ে জড়িয়ে আছে বিচিত্র সব লতাপাতার দল, কেউ আলতো ভাবে, কেউ বা ঘন আশ্লেষে। মাটির কাছে ঝোপঝাড় আর বুনো ঘাস। উপরি পাওনা হল বনের মাটিতে লাল, হলুদ, সবুজ, বাদামি পাতার পুরু নরম চাদর। ডুয়ার্সের সব বনপথেই হাতিদের অবাধ যাতায়াত। কিন্তু এই টিয়াবনে নাকি হাতি ঢোকে না। তাই অন্য বনগুলির তুলনায় এই পথ মানুষের কাছে নিরাপদ। সেজন্যই এখানে কাছাকাছি হোটেলগুলি রয়েছে। কিন্ত হাতি ঢোকেনা কেন? লক্ষ্য করলাম, মধ্যম উচ্চতার গাছের সারিরা এখানে অনুপস্থিত। বুঝলাম, এ বনে হাতির লুকোবার জায়গা নেই।




           মধ্যম উচ্চতার গাছের সারিরা এখানে অনুপস্থিত; এ বনে হাতির লুকোবার জায়গা নেই 

মূর্তি থেকে সব থেকে আকর্ষণীয় ঘোরার জায়গা হল, গরুমারা অভয়ারণ্য। নির্দিষ্ট দিনে পরিবারের সবাই মিলে ভাগাভাগি করে বনবিভাগের দুটি জিপে চড়ে বসলাম। দুপুর অল্পকাল হল গত হয়েছে। চারিপাশে বিকেলের নরম আলো। হুড খোলা জিপ। মাথার ওপরে ছাউনি না থাকলেও রড আছে, ধরে বসা যায়। এক একটি জিপে পিছনে আমরা ছজন। সামনে চালকের পাশে একজন করে সহকারী আছে। রাস্তা মসৃণ, দুপাশে গরুমারা জঙ্গল। জিপ ছুটছে, হু হু হাওয়া। হাওয়ার ঝাপটায় টুপি উড়ে যাচ্ছে। চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গরুমারা নামটার মধ্যে হিংস্র শ্বাপদের ভয় লুকিয়ে আছে।

মধ্যপ্রদেশের মহাকাল পর্বতের অমরকন্টক শৃঙ্গে উঠতে গেলেও জঙ্গল পেরোতে হয়। প্রথমবার সে বনের নাম শুনে চমকে উঠেছিলাম। বনের নাম ‘অচানকমার’, অর্থাৎ sudden attack। এখানেও তেমন। নিশ্চয় সেই কবে থেকে বন বস্তির রাখালেরা বন এলাকায় গরুর বাগালি করতে যেত। কিন্তু শ্বাপদের আক্রমণে সব গরু বাড়ি ফেরাতে পারেনি।

অভয়ারণ্যের প্রবেশ দ্বার আসতে এখনও কিছুটা পথ বাকী। হঠাৎ আমাদের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। চালক বাঁ দিকে ইশারা করলেন। রাস্তা থেকে জঙ্গল আলাদা করা আছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। বেড়ায় মৃদু বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। পশু ও মানুষ উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বন বিভাগের এই ব্যবস্থা। কিন্তু বেড়ার ওপারে ওটা কী? গাছের ডাল পালা নড়ছে। একটা সাদা লম্বাটে জিনিস, ওটা হাতির দাঁত না! চালক ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে নিঃশব্দ থাকতে বলছেন। কয়েক মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, জঙ্গলে প্রবেশের আগেই কি তরাই বনের রাজদর্শন সম্ভব হবে? বেশিক্ষণ লাগেনি। গাছের আড়াল থেকে ঐ তো বেরিয়ে আসছেন বিশাল গজরাজ। এবারে মাথা আর সামনের পা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এবারে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বিশাল বড় বড় কান দুটো নড়ছে। পুরো আত্মপ্রকাশের আগে বোধহয় মানুষের উপস্থিতির আঁচ পেলেন। পুরো শরীরটা পাতার আড়াল থেকে বেরোনোর আগে থমকে গেল। কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে দর্শনের সুযোগ করে দিয়ে জিপ আবার চলতে শুরু করেছে। বন রাজ্যে ঢোকার আগেই রাজদর্শন। মনটা খুব খুশি খুশি লাগছে।


বনদপ্তরের হাতি 

টিকিট কেটে গরুমারা অভয়ারণ্যে ঢোকা গেল। বিকেলের আলোয় অরণ্য বড় মোহময়ী লাগে। আমাদের দুটো জিপের সঙ্গে অন্য ট্যুরিস্টদের অারো দুটো জিপ রয়েছে। গোল বাধল অন্য ট্যুরিস্টরা আমাদের জিপের সঙ্গে যেতে চাইছেন না। তাঁরা ভাবছেন, সামনের জিপ জীবজন্তু দেখতে পাবে, কিন্তু যে জিপ পিছনে থাকবে তারা সুযোগ হারাতেও পারে। কিন্তু জঙ্গল গাড়ির রেষারেষি বা অসন্তোষ প্রকাশের জায়গা নয়। তাই দুটি দুটি করে জিপ আলাদা দুটি বনপথ ধরে। বাঁকে বাঁকে দেখা হয়। তারপরে আবার চোখের আড়াল। অনেক পাখি ডাকছে। আহা যদি পাখি চিনতাম! গাছ, পাখি চিনি না বলে, অনেক কিছু চোখের সামনে থাকলেও তাদের অস্তিত্ব অদেখাই থেকে যাচ্ছে। বড় আফসোস হয়।

হঠাৎ শুনি হাসির শব্দ। শুঁড়িপথ ধরে আদিবাসী মহিলারা গল্প করতে করতে চলেছেন শুকনো পাতা আর কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে। চালকেরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁদের সাবধান করে দিলেন, “তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও, ঠাকুর আছে”। দেখলাম একথা শুনে মহিলাদের মুখ ভয়ে সাদা। গল্প থামিয়ে দ্রুতপদে তাঁরা বনপথের বাঁকে অদৃশ্য হলেন। ঠাকুর মানে? চালকের কথা শুনে আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। অরণ্যে প্রবেশের আগে আমরা নিজের চোখে ঠাকুর দেখে এসেছি। বিরাট বড় বড় কান নাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ঠাকুর বলে ডাকা হয় কেন? চালক কাম গাইডের মুখে অর্থবহ হাসি। বললেন, আর একটু অপেক্ষা করুন। নিজেরাই বুঝতে পারবেন। বিকেলের রোদ আর হলুদ নেই, লালচে হয়ে এসেছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যদেব লুকোচুরি খেলছেন। সামনে মাঠ। একটু দূরে আবার জঙ্গল শুরু হয়েছে। এবারে আশপাশে কিছু কিছু একচালা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। চালক বললেন গরুমারার ভিতরে এটি একটি ছোট আদিবাসীগ্রাম বাবন বস্তি। সামনে একটি পাকাঘর, কিন্তু দেয়াল পুরো ভাঙা। এঘরের ইতিহাস শুনে অবাক হলাম। পাশের ঘরটি প্রাথমিক ইস্কুল। ভাঙা ঘরটি ছিল ঐ ইস্কুলের রান্নাঘর। কয়েকমাস আগে মিডডে মিলের খিচুড়ির গন্ধে হাতির দল হানা দিয়েছিল। ঘর ভেঙে খিচুড়ি খেয়ে গেছে। ক্ষেতে যখন ফসল পাকে, বর্গি হাতির দল আসে। ফসল কিছু খায়, বাকিটা তাদের পায়ের তলায় পিষে যায়। টাকা পয়সা, পরিশ্রম, খাদ্যসুরক্ষা, সম্বৎসরের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সব কিছুর এক বেলাতেই সর্বনাশ হয়ে যায়। মানুষের প্রাণও যায় হরবখত। এই কারণে হাতি এই বন-বস্তির মানুষদের কাছে সাক্ষাৎ যমদূত। হাতিকে এঁরা দূর থেকে পূজা করেন, দয়া ভিক্ষা করেন। তাই হাতিকে কেউ নাম ধরে ডাকে না। ঠাকুর বলে ডাকা হয়। মনে পড়ল, মূর্তি নদীর পাশে যে রিসর্টে আমরা আছি, তার পাশে মহাকালের পুজো হচ্ছিল। মণ্ডপে শিবঠাকুর আর হাতি ঠাকুর দুজনেরই বিগ্রহ ছিল। দেবতাত্মা হিমালয়ের দুই অধীশ্বরের কৃপাপ্রার্থী এখানকার মানুষ। বন-বস্তির সীমান্তে এক অদ্ভুত গাছ। তার ডাল থেকে এক ধরণের গোলগোল কিন্তু বৃহদাকার ফল ঝুলছে। চালক জানালেন এত বছর এ বনে জীবিকা নির্বাহ করছেন, এ গাছে ফল হতে প্রথমবার দেখলেন। এ বছরে ফলেছে। আদিবাসীরাই জানিয়েছেন, এ ফলের নাম মহাবেল।

গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি আবার জঙ্গলের রাস্তা ধরেছে। ওপাশে উঁচু, সোজা সরলবর্গীয় গাছ বেশি ছিল। এদিকে বিশাল বিশাল ডালপালা ছড়ানো পর্ণমোচী গাছ বেশি। অনেক ডাল ঝুঁকে গায়ে এসে পড়ছে। হুড খোলা জিপে খুব সাবধানে বসতে হচ্ছে। অসতর্ক হলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সরু ডাল তীক্ষ্ণ ফলার মতো চোখেও ঢুকে যেতে পারে। একটা ছোট ঝোরা বয়ে যাচ্ছে। নুড়ি পাথরে ভরা তার বক্ষ। মাঝখান দিয়ে তিরতির করে বইছে জলের ধারা। কিন্তু তার চাইতে বড় জিনিষ হল, নদীর এপাশে ওপাশে অনেকগুলো ময়ুরী, আর কয়েকটা বিশাল ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুটো ময়ুর এতটাই কাছে, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। নদী পেরিয়ে কিছুটা দূর এগিয়েছি। বন মনে হচ্ছে একটু হাল্কা হয়ে আসছে। ও আচ্ছা বন পেরিয়ে পাকা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।


তিরতির করে বহমান জলের ধারা 


নদীর এপাশে ওপাশে অনেকগুলো ময়ুরী, আর কয়েকটা বিশাল ময়ুর 

বন চিরে পিচ সড়ক, দুপাশে ঘন ছায়ায় ঢাকা বৃক্ষরাজি। জিপ ছুটছে দুরন্ত গতিতে। একঘেয়ে জীবন যেন মিথ্যে। সেই কবে ছোটবেলায় সিনেমা দেখেছিলাম আফ্রিকান সাফারি। কিংবা বেনহারের রথের দৌড়। সব মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু নানা বনের মধ্যে এত জোরে গাড়ি চলা তো ভালো নয়। বনের বাসিন্দারা রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়তে পারে। আমার শখ, আমার থ্রিল, তার জন্য ওদের জীবন নিয়ে খেলতে পারিনা। কিছুতেই না। চালককে বললাম আমাদের তাড়া কম, একটু ধীরে চলতে। চালক বললেন শীতের বেলা এমনিতে ছোট, তায় জঙ্গলে ছায়া, খুব দ্রুত অন্ধকার নামে। শেষ বিকেলে জীবজন্তুর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু অন্ধকার নেমে গেলে সব আশায় ছাই পড়বে, তাই তিনি তাড়া করছেন। আমাদের অত শত অভিজ্ঞতা নেই। যা হোক গাইডের ওপরে সব ছেড়ে আবার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে মগ্ন হলাম। আর একটু এগিয়ে জিপ এবার পিচ রাস্তার ওপাশের জঙ্গলে ঢুকল। আবার সেই সংকীর্ণ বনপথ। আমরা যেমন ঢুকছি, অনেকগুলো জিপ তেমন সাফারি সেরে বেরিয়ে আসছে। তাদের সময় শেষ।

পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়েও পাশের ফিরতি পথের জিপ থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে, কিছু দেখতে পেলেন ভাই? আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের চটজলদি জবাব শুনে চমকে যাই – হ্যাঁ হ্যাঁ গাছে গাছে বুনো পিঁপড়ে দেখলাম প্রচুর। দুই জিপেই হাসির রোল ওঠে। হাসির রেশ শেষ হবার আগেই উল্টো মুখে চলতি জিপ দুটি পরস্পরের থেকে অদৃশ্য হয়। মনে ভাবি পুরোটা তো রসিকতা নয়। জঙ্গলকে বুঝতে হলে শুধু বড় বড় জন্তু জানোয়ার দেখাটাই সব নয়। বড় গাছ, ছোট গাছ, ঝোপ ঝাড়, লতা পাতা, কীট পতঙ্গ, পশু পাখি সবাইকে নিয়ে পুরো সংসারটাকেই অনুভব করতে হবে। ছোট ছেলের মুখের কথা যেন একটা বড় শিক্ষা দিয়ে যায়। তবে চালক আশ্বাস দেন, যে আমরা যে সময়ে ঢুকেছি, সে সময়ে সচরাচর পর্যটকদের কপাল চওড়া থাকে। দেখি বনদেবীর কৃপা পাই কি না।

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। সম্বিত ফিরতে দেখি, চালক দাঁড়িয়ে উঠে ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে নিঃশব্দ থাকার ইশারা করছেন। ওনার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, পথের বাঁদিকে ঘন পাতার আড়ালে একটা কালো কিছু যেন রয়েছে। হাতি দেখার সময়ে যেমন ডালপালা নড়ছিল, এখানে তেমন নয়, বরং একটু যেন বেশিই স্থবির, কোনো নড়নচড়ন নেই। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এলে মনে হল সামনের দিকে একটা বিশাল মুখ। তারপর পাতার আড়ালে দৃষ্টিগোচর হল একটা বাইসন রাস্তা থেকে সামান্য দূরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতা স্কুলে আমাদের সন্ন্যাসিনী শিক্ষিকা বড় মিনুদির বাংলা ক্লাসের পড়া মনে পড়ে যায় – ‘নিবাতনিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্’ বাতাস না থাকলে প্রদীপের শিখা যেমন নিষ্কম্প থাকে, তেমনই নিশ্চল এই বাইসন। অপেক্ষা করছে আমাদের সরে যাওয়ার জন্য। চালক জানালেন একটা যখন আছে, তখন আরো বাইসন কাছাকাছিই আছে। জিপ আবার স্টার্ট দিল। আরো বাইসন কাছাকাছি আছে, কথাটা মনের মধ্যে ঘুরছে। বেশিদূর যেতে হল না। এবারে পথের ডানদিকে দেখা গেল একদল বাইসন। চালক দেখিয়ে দিলেন দলনেতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে আছে পুরো দল। রাস্তা পেরোবে। একটু সরে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের কাছে ভালো ক্যামেরা ছিল না। চালক নির্দেশ দিলেন ছবি তুলতে হলে ফোনের ভিডিও ক্যামেরা অন করে প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আমার ভাই ভিডিও ক্যামেরা অন করেছে দেখে, আমি ফোনের স্টিল ক্যামেরা অন করে রাখলাম। বাইসন বেরোনো মাত্র ক্লিক মারব। এক এক করে তিনটি বিশালাকায় পূর্ণ বয়স্ক বাইসন ঊর্দ্ধশ্বাসে রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে চলে গেল। কিন্তু হায়, তিনবারই আমার রিফ্লেক্স ফেল। ফোনে ট্যাপ করার সময় দিল না। বুঝলাম কেন গাইড বলেছিলেন ভিডিও ক্যামেরা অন করতে। এদের যা গতি, আমাদের মতো আনাড়িদের পক্ষে স্টিল ক্যামেরায় বন্দী করা অসম্ভব। একটাই সান্ত্বনা, ভাই ভিডিও করতে পেরেছে।

আমাদের যে সৌভাগ্য হল, আমার কর্তার ভাগ্যে তা হল না। কারণ তিনি ছিলেন অন্য জিপে। সে গাড়ির চালক অন্ধকারকে ভয় পান, তাই অনেক আগেই ফেরার পথ ধরেছেন। সত্যি, ট্যুরিস্টদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কোন গাইড দক্ষ, আর কে নয়। বনদেবীর কৃপার বিষয় তো আছেই, উপরি যদি অদক্ষ, আনাড়ি গাইড কপালে জোটে, দুর্ভাগ্যের আর আফসোসের সীমা থাকে না। হরিদ্বারের উপকণ্ঠে রাজাজী ন্যাশানাল পার্কেও একই ঘটনা ঘটে ছিল। আমরা পাহাড়ের গায়ে ছানা সমেত বিশাল হাতির দল দেখলাম, পথের ওপরে বসে থাকা চিতাবাঘ দেখলাম। অথচ আমার কর্তার জিপটি অন্ধকারের ভয়ে বহুক্ষণ আগেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কর্তা প্ল্যান করেন, ছুটোছুটি করে ট্রেনের টিকিট কাটেন, হোটেল বুকিং করেন, যাতায়াত, খাওয়া দাওয়ার সুবন্দোবস্ত করেন, অথচ বনদেবী ওনার ওপর কৃপা দৃষ্টি দেন না, দুবার প্রমাণ পেলাম। সূর্যদেব পাটে বসেছেন। জিপ ফেরার পথ ধরেছে। হঠাৎ আমাদের অবাক করে দিয়ে এক পথের বাঁকে গাড়ি উল্টো মুখে গভীর জঙ্গলের দিকে চলতে শুরু করে। কিছু দূর এগিয়ে দেখি বিশাল জলাশয়, ওধারে বোধহয় নদী আছে। আমাদের আগে থেকেই আরও তিনটি জিপ ছড়িয়ে, ছিটিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। কিছুটা দূরে পাহাড়। গরুমারার পাহাড়ী অংশ আছে, এক থাজানা ছিল না। গোধূলির আলোর শেষ রেশ পাহাড়ের গায়ে। আমাদের চারপাশে আঁধার নামছে। জল-জঙ্গল-পাহাড়-গোধূলি-আঁধারের ছায়া, একি আমারই পরিচিত বঙ্গদেশ! একটা অপার্থিব অনুভূতি মনটাকে ছেয়ে ফেলছে। এখানে আসার জন্যই কি আমার জীবনটা এতদিন অপেক্ষায় ছিল? কানের কাছে চালকের চাপা স্বর শুনে চমকে উঠি। তিনি বলছেন। জলের ধারে ন্যাড়া গাছ। আপনি নিজেকে আর গাছ মনে মনে এক সরলরেখায় যুক্ত করে সেই রেখা বরাবর পাহাড়ের খাঁজটা দেখুন। জীবনে প্রথমবার এমন জায়গা। অনভিজ্ঞতায়, আর চরাচর ব্যাপী ধূসর আলোয় ঠিক ঠাহর হয় না। শুধু মন প্রাণ দিয়ে সরলরেখা খুঁজি। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসে। যা অদৃশ্য তা দৃশ্যমান হয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জলের দিকে নামছে হস্তীযূথ। বড়দের শুঁড়ের তলায় শিশুরাও আছে। এপাশে পর্যটকরা বাক্যহীন, স্থবির। কন্যা ও দুই ভ্রাতুষ্পুত্র গা ঘেঁষে আসে। ওদের জড়িয়ে ধরি। ওপাশে হস্তীমায়ের সন্তান, এপাশে আমার। প্রকৃতির কোলে ওদের স্বাধীন বিচরণ মনে বড় বাজে, যন্ত্রণা দেয়। কারণ আমার নোঙর বাঁধা কিনারার কাছে। চমক ফেরে, হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা বার করে পাগলের মতো কর্তাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। বলতে চাই ফিরে এসো, দেখে যাও। লাভ হয়না। এখানে ভোডাফোন, এয়ারটেল কারোর টাওয়ার নেই। জিও ফাইবার করে, মেসেজ করার চেষ্টা করি। মেসেজ ডেলিভারি হয় না। ধীরে ধীরে আঁধার নামে। নদী, পাহাড়, দূরের জঙ্গল সবই অদৃশ্য হয়। গাড়িগুলির হেডলাইটের তীব্র আলো জ্বলে ওঠে। সে আলোয় পথ চিনে যে যার গাড়িতে চুপচাপ উঠে বসি। রাতের জঙ্গলে নিরাপত্তা কম। এবারে বিদায় নেবার পালা।

আঁধার বন পথ নিঝুম, শুধু গাড়ির শব্দ। ঘোর লাগা মন নিয়ে মাথা নিচু করে বসেছিলাম। কী মনে হয় পিছন ফিরে ফেলে আসা বনপথের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। মুখ তুলে গতির পিছন দিকে তাকাই। এক লহমায় ছোটবেলার বাংলা পাঠ্য মনে পড়ে যায়, “আহা, কী দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না”। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র, মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। গরুমারার চরাচরে জোছনার বান ডেকেছে। বনপথ অনেক দূর পর্যন্ত চোখের সামনে স্পষ্ট। শুধু বড় বড় গাছের ছায়াগুলো কাঁপতে কাঁপতে দূরে সরে যাচ্ছে। রাতের জঙ্গলের সেই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য পান করতে করতে মনে কাঁটা বেঁধে, কর্তা তো কিছুই দেখতে পেলেন না। এক যাত্রায় পৃথক ফল, বিধির ষড়যন্ত্র। তখনও জানিনা আরও কিছু বাকি আছে। আবার জিপ দাঁড়িয়ে যায়। চড়া হেডলাইটের আলোয় দেখি বাইসনের দল ঠিক আগের মতোই ঊর্দ্ধশ্বাসে রাস্তা পার হচ্ছে। তৃপ্ত, পূর্ণ মন নিয়ে বনের সীমানার বাইরে আসি। কর্তা জিজ্ঞাসা করেন, এত দেরী হল কেন? আমার বলার ছিল, তোমার গাড়ি এত তাড়া করল কেন? শেষ পর্যন্ত নীরবই থাকি, কিছুই বলা হয় না। বাচ্ছারা কিছু বলার চেষ্টা করে। শুনতে পাই ওগাড়ির অন্য সওয়ারিরা ছোটদের খেপাচ্ছে, কিচ্ছু দেখেনি, যত্ত সব বানানো। মনে মনে হাসি, যা দেখেছি তা বানানো না হলেও স্বপ্ন তো বটেই। ওরা কিছুই দেখতে পায়নি, তাই মনের ঝাল মেটাচ্ছে। বাচ্ছাদের বলি শান্ত হতে। দু পাশে জঙ্গল আর চা বাগানের মধ্যে দিয়ে পাকা সড়ক জোছনায় ভাসছে। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। মাথায় উলের রুমালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছি। আমরা এখন মূর্তি নদীর ধারে রিসর্টে ফেরত যাচ্ছি।

*প্রাক্তন বিভাগীয় অধ্যাপিকা 

বর্তমানে প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের অধ্যাপিকা

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়