ক্যাপাদকিয়া (Cappadocia)ঃ প্রকৃতি- মানুষ আন্তঃ সম্পর্কের ইতিকথা

২১/১২/২০১৮

মনীষা দেব সরকার*


তুরস্কের এশিয়া অংশের প্রায় মধ্যভাগে আনাতলিয়া মালভূমিতে অবস্থিত এই ছোট্ট রাজ্য ক্যাপাদকিয়া। বহু প্রাচীন রাজ্য এটি। বহু সভ্যতার ইতিহাস, বহুবার ভূমিরূপ পরিবর্তনের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও মানুষের বিস্ময় উৎপাদন করে চলেছে। এখানকার ভূমিরূপ পৃথিবীর এক অত্যাশ্চর্য বিস্ময়। আর তার সঙ্গে সখ্যতা করে আজও প্রবহমান মানুষের সভ্যতার বিবর্তনের এক বিরল ধারা।
ক্যাপাদকিয়া, এখানকার বাড়িগুলির রঙ ভূপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে 
তুরস্কের মধ্যস্থিত এশিয়া মাইনরের এক বিস্তীর্ণ রাজ্য ক্যাপাদকিয়া। গ্রীক ভৌগোলিকরা একে বলতেন Cappodax, পারস্য দেশে এর নাম ছিল কাটপা্টুকা (Katpatuka) যার অর্থ ‘সুন্দর ঘোড়ার দেশ’ (Land of beautiful  horses)
বর্তমানে এখানকার ভূমিরূপকে চাঁদের পিঠের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এখানে রয়েছে নানা বর্ণের, নানা আকৃতির ‘fairy chimney’ (এক বিশেষ গঠন ও আকৃতির ভূমিরূপ)তাকে তুখোড় ভাস্করের মত মানুষ খোদাই করে করেছে নানা প্রকার বাসস্থান এবং ভূগর্ভ-নগরী। এর তুলনা সারা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। প্রাকৃতিক ভূমিরূপকে এমনভাবে ব্যবহারের নজিরও সারা পৃথিবীতে বিরল।

প্রাকৃতিক fairy chimney’ যেন জোড়ায় জোড়ায় মহিলারা চলেছেন  
রোম সম্রাট অগাস্টাসের সময়ে প্রায় ১৭ টি খণ্ডে লিখিত ‘Geographika’ নামক পুস্তকে Strabon ক্যাপাদকিয়ার নামোল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন এটি একটি বিস্তৃত অঞ্চল যার দক্ষিণে রয়েছে Taurus পর্বত, পশ্চিমে Aksaray নামক একটি রাজ্য, পূর্বে Malatya নামক আর একটি রাজ্য ও উত্তরে এর বিস্তার প্রায় কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত। বর্তমানে এখানে বেশ কয়েকটি বড় শহর রয়েছে যেমন Nevsehir, Keyseri ইত্যাদি। তবে মোটামুটিভাবে ক্যাপাদকিয়া Uchisar, Goreme, Avanos, Urgup, Derinkuya Kayamalki এবং Ilhara নামক স্থানগুলি নিয়েই পরিব্যাপ্ত। এই প্রত্যেকটি স্থানই দর্শনীয় এবং চিত্তাকর্ষক।
 দূরে Mt. Erciyes, যার অগ্ন্যুৎপাতের ফল স্বরূপ এই ভূমিরূপ গড়ে উঠেছে
ক্যাপাদকিয়ার এই ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১০ মিলিয়ন (মিওসিন যুগের শুরু) বছর আগে। মূলতঃ এটি একটি অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ। নিকটবর্তী শহর Keyseri র অনতিদূরেই অবস্থিত ক্যাপাদকিয়া থেকে প্রায় ৫০ কি.মি. দূরে Mount Erciyes (Argaeus) থেকে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নানাপ্রকার গলিত আগ্নেয় পদার্থ (ignimbrite, ash, tuff etc.) নির্গত হয়। প্রধানতঃ ‘tuff’-ই সঞ্চিত হয় কোথাও কোথাও প্রায় ১০০ মিটারের বেশী পুরু হয়ে, নানা বর্ণে ও নানা বুননে পরবর্তীকালে বহু বছর ধরে বায়ু ও বৃষ্টির জলের ক্ষয়কার্য্যে সৃষ্ট হয় বর্তমানের অত্যাশ্চর্য্য ভূমিরূপ। অন্যান্য স্থানের আগ্নেয় ভূমিরূপের থেকে এটি সম্পূর্ণভাবে আলাদা।
'Castle' বা দূর্গের ন্যায় ভূমিরূপ যা প্রথমিকভাবে অগ্ন্যুৎপাতজনিত কারণে সৃষ্ট, পরবর্তীকালে আবহবিকার ও ক্ষয়ের ফলেে এই রূপ ধারণ করে, মানুষ এর আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করত

উচ্চতা বেশী না হলেও ক্যাপাদকিয়া সমতলভূমির সঙ্গে রয়েছে খর্বাকৃতি পাহাড়, ব্যবচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণী এবং কতিপয় মৃত আগ্নেয়গিরি। তবে এদের মধ্যে যার দ্বারা এই ভূমিরূপ সৃষ্ট সেই
Mount Erciyes-এর উচ্চতা ৩৯১৬ মিটার (১২,৮৪৮ ফুট), ভূমিভাগের উচ্চতা বেশী না হওয়ার কারণে ৫০ কি.মি. দূরের ক্যাপাদকিয়া থেকেই এটি বেশ পরিষ্কার নজরে পড়ে। শীতকালে এটির শীর্ষদেশ তুষারাচ্ছাদিত হয়ে যায় এবং এই সময় ice-skiing  একটি জনপ্রিয় ক্রীড়ানুষ্ঠান।
ভূতাত্বিক ঘটনাবলীঃ  
ইউরোপীয় আল্পস্‌সহ দক্ষিণ আনাতলিয়ার টরাস পর্বতশ্রেণী সৃষ্ট হয় টার্শিয়ারী যুগে প্রায় ৬৫ থেকে ২ মিলিয়ন বছর আগে। এই সময়ের মধ্যে অ্যালপাইন উপযুগে সৃষ্ট হয় পর্বতশ্রেণী, গভীরখাত ও বিশাল অবনমিত অঞ্চল। ফাটলের মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসা গলিত ম্যাগমা সঞ্চিত হয়ে সৃষ্ট হয় Erciyes, Develi, Melenciz, Kegibovdoran এবং  Hasan Dag  আগ্নেয়গিরি ও জ্বালামুখগুলি। পরবর্তীকালে অসংখ্য অগ্ন্যুদ্গমের ফলে এগুলি আকারে বর্ধিত হয়ে সৃষ্টি করে আগ্নেয় গিরিমালা। টরাস পর্বতশ্রেণীর প্রায় সমান্তরালেই অবস্থিত রয়েছে এই আগ্নেয়গিরি শ্রেণী। লাভা প্রবাহের ফলে ধীরে ধীরে আবৃত হয়ে যায় পূর্বের অবনমিত ভূতল, পাহাড় ও উপত্যকা। আজকের মালভূমি রূপের এটিই ভূতাত্বিক কারণ।        
বর্তমান ভূমিরূপের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় যান্ত্রিক আবহবিকার, নদী, বায়ু, বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতকে। ক্যাপাদকিয়ার জলবায়ু তীব্র ধরনের। এখানে উত্তাপের দ্রুত পরিবর্তন, প্রচুর বৃষ্টিপাত ও গলিত তুষারের প্রভাবে আগ্নেয়গিরি নির্গত ও সঞ্চিত ‘tuff’ সহজেই ক্ষয়িত হয়। যদিও সেই তুলনায় তার ওপরে সঞ্চিত ব্যাসল্ট লাভা শিলা ততটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। ফলতঃ tuff’ সৃষ্ট ভূমিরূপ সহজেই স্তম্ভ আকৃতি গ্রহণ করে এবং এই স্তম্ভগুলির মাথায় টুপির মত থাকে ‘basalt capping’
স্তম্ভাকৃতির 'Tuff' যা 'Basalt Capping' দ্বারা আচ্ছাদিত, ব্যাসাল্ট ক্ষয়ের কিছুটা প্রতিরোধক  
উত্তাপের দ্রুত পরিবর্তনও শিলাস্তরকে খণ্ডবিখণ্ড করে (block disintegration and shattering)এছাড়া বসন্তকালে বরফ গলে গেলে পাথরের খাঁজে সঞ্চিত জলের দ্রুত জমাটবদ্ধটা ও গলনের ফলেও শিলা খণ্ডবিখণ্ড (কেলাসন প্রক্রিয়া) হয়। তবে এই অঞ্চলের সবথেকে ক্রিয়াশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষয়কার্য্য করে বৃষ্টিপাত ও নদীপ্রবাহ। ভারী বৃষ্টি মালভূমির মসৃণ অঞ্চলটিকে প্রণালীক্ষয়ের (gully erosion) মাধ্যমে ব্যবচ্ছিন্ন করে ও প্রচুর ভূমিক্ষয় করে। ক্ষয়জাত এই পদার্থগুলি সহজেই নদীদ্বারা বাহিত হয়ে যায়।
'Tuff' যা পরবর্তীকালে 'Gully Erosion' এর ফলে এইরূপ ভূভাগ সৃষ্টি করেছে
প্রকৃতপক্ষে অঞ্চলটিতে নদী ও উপনদীগুলি স্থানে স্থানে আগ্নেয়শিলা ও মৃত্তিকাকে অপসারিত করে গভীর খাত তৈরি করেছে ও একই সঙ্গে স্তম্ভাকৃতি ভূমিরূপগুলির আকৃতি গঠনে সাহায্য করেছে। প্রধানতঃ জলপ্রবাহের উল্লম্ব ক্ষয়কার্য্যই এই সূচাকৃতি স্তম্ভগুলির আকৃতির (pinnacles) জন্য দায়ী। একাধিক প্রণালীক্ষয় পাশাপাশি সরতে সরতে একসময় একই সঙ্গে প্রচুর মৃত্তিকা/শিলার অপসরণ ঘটলে এই আকৃতিগুলি গড়ে ওঠে। ক্যাপাদকিয়ার Zelve এবং Goreme অঞ্চল এই প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি ও নদীপ্রবাহের দ্বারা সৃষ্ট।
সূচাকৃতি ভূমিরূপ যা পরবর্তীতে মানুষ বাসস্থানের উপযোগী করে নিয়েছে


সূচাকৃতি বা 'Pinnacle' স্তম্ভ
ভূমিরূপঃ    
আগ্নেয় সঞ্চয় ‘tuff’ ক্ষয় ও অপসারণের ফলেই সৃষ্ট হয়েছে আজকের ক্যাপাদকিয়ার ভূমিরূপ। এই ভূমিরূপের বিশেষ আকৃতির নাম ‘fairy chimney’। তুরস্কের ইউরোপীয় অংশের অন্যতম বৃহৎ সুপরিচিত শহর ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানের প্রাসাদ ‘Topkapi’ র রসুইঘরের চিমনীও অনুরূপ আকৃতির।
অটোমান সুলতানের প্রাসাদ ‘Topkapi’ র রসুইঘরের চিমনী, ক্যাপাদকিয়ার ভূমিরূপের আদলে নির্মিত
বিভিন্ন প্রকারের ‘fairy chimney’ দেখা যায় – Caps (ব্যাসল্ট  capping আছে), কোণাকৃতি (cones), ছত্রাকৃতি (mushrooms), স্তম্ভাকৃতি (columns) ও সুচাগ্র শিলা (pointed rocks)এক একটি অঞ্চলে এক এক ধরনের আকৃতির প্রাধান্য দেখা যায়। উপত্যকা অঞ্চলে সাধারণতঃ বৃষ্টির জলের বাঁকযুক্ত শিলা (sweeping curves) দেখা যায় যেগুলি প্রধানতঃ উপত্যকার দুই ঢালে অবস্থিত।

'Disintegration' এবং 'Differential Erosion'  'Tuff' গুলিকে যেন পরিত্যক্ত শহরের চেহারা দিয়েছে  
ঐতিহাসিক ক্যাপাদকিয়াঃ

আনাতলিয় সভ্যতা প্রায় ১২০০ খ্রিস্তপূর্ব সময়ের প্রাচীন। বেশ কয়েকটি সভ্যতার উত্থান পতনের সাক্ষী এ অঞ্চল। এখানে হিট্টাইট (Hittite) সভ্যতাও ৩০০০ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ – ১৭৫০ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ তে প্রতিষ্ঠিত অ্যাসিরিয় (Assyrian) বাণিজ্য বসতি (trade colony) ছিল। এঁরা উত্তর মেসোপটেমিয়া থেকে বাণিজ্যিক সূত্রে এখানে আসতেন। আনাতলিয়া ছিল সোনা, রূপা ও তামায় সমৃদ্ধ তবে এদেশে টিন অলভ্য হওয়ায় ব্রোঞ্জ তৈরি সম্ভব হয়নি। সেজন্য টিন বাণিজ্যের অন্যতম আমদানি ছিল। তার সঙ্গে ছিল বস্ত্রাদি ও সুগন্ধী।
হিট্টাইট পরম্পরা আজও পরিলক্ষিত হয় এদের শিল্পকর্মে
রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়েছেন শিল্পী 
ক্যাপাদকিয়ায় পারস্য সাম্রাজ্যের প্রভাবও ৫৮৫ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ – ৩৩২ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায়। গ্রীক সম্রাট অ্যালেক্সান্ডার দুবার (৩৩৪ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ ও ৩৩২ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ) পারস্য সেনাকে পর্যুদস্ত করেন ও ক্যাপাদকিয়া তাঁর রাজত্বে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। ১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ক্যাপাদকিয়া রোম সম্রাটের নিয়ন্ত্রনে আসে ও ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এই সময় পূর্বদিক থেকে আরও অনেক আক্রমণ ঘটে, বিশেষ পারস্যদেশ (Iran) থেকে। রোমীয় রাজত্ব পরবর্তীকালে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায় এবং ক্যাপাদকিয়া পূর্বাংশে থেকে যায়। ১০৭১ – ১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সেলযুক (Seljuk)  তুর্কীদের রাজত্বকাল। এদের আগমন আনাতলিয়ায় নতুন ইতিহাস রচনা করে। প্রথমে পারস্য, পরে মেসোপটেমিয়া ও বাইজানটাইন (Byzantine) সাম্রাজ্যকে পরাভূত করে তারা সমগ্র আনাতলিয়া অধিকার করে।
হস্তশিল্পে পারস্যের প্রভাব সুস্পষ্ট 
নানা আক্রমণে বিপর্যস্ত ও অশান্তিপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রথম ক্যাপাদকিয়া শান্তি আনে ওটোমানরা। ১৮শ শতকে প্রথমে তৎকালীন ওটোমান সুলতানের তত্বাবধানে বহু গঠনমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়। অবশেষে ১৯শ শতকের শেষাংশে ওটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ও ১৯২৩ সালে তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র (Turkish Republic) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।  
সনাতন সূচী শিল্প ও 'Lace' এর কাজে এরা দক্ষ 
মৃৎশিল্পের ওপর তুলির টান 
পাথরের 'Coaster'  

শিল্পকর্ম যা  হিট্টাইট সভ্যতার ধারক
ভূমিরূপ ও মানুষের আন্তঃসম্পর্কঃ
মানুষ তার নিজের বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রকৃতিতে ব্যবহার করেছে। প্রকৃতি তার কাছে সম্পদ স্বরূপ। প্রাকৃতিক পরিবেশ বহুলাংশেই মানুষের কার্য্যকলাপকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। ক্যাপাদকিয়ার অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বহু যুগ ধরেই সেখানকার মানুষদের কার্য্যকলাপ ও জীবনধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।ক্যাপাদকিয়ার ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রয়েছে তৎকালীন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও কার্য্যকলাপ যেটি গঠন করতে সাহায্য করেছে এই অঞ্চলে ভৌগোলিক বিশেষতঃ অগ্ন্যুদগম সৃষ্ট ভূমিরূপ।
 'Tuff' কোমল হওয়ায় মানুষ সহজেই তাকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী আকার দিয়ে বসবাসের উপযোগী বানিয়েছেন

 'Tuff' কেটে নির্মিত দোতলা বাড়ি 
'Tuff' কে প্রজ্বলিত করে খাবার গরম রাখা হয় যা প্রকৃতির সাথে অভিযোজনকেই নির্দেশ করে 

 'Tuff' এর ভিতরের অংশ, জানালা ও কুলুঙ্গী 
ক্যাপাদকিয়ার অবস্থান পারিপার্শ্বিক দেশগুলির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই রাজ্যের নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ তাকে বারংবার বিভিন্ন বহিঃশত্রুর আক্রমণে প্ররোচিত করেছে, প্রলোভিত করেছে। সাধারণ মানুষ অতএব আক্রমণের সময়ে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় ও দূরত্বে সরিয়ে নিয়েছে। আগ্নেয় শিলা tuff’ গঠিত ভূমিরূপের মধ্যেই মানুষ তার আশ্রয় তৈরি করে নিয়েছে। 
প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্ট মানুষ বসবাসের কার্যে ব্যবহৃত হত 
শিলা খোদাই করে বাসগৃহ, সুড়ঙ্গ, চার্চ এমনকি ভূপৃষ্ঠের নিচে ১০ থেকে ১১ তলা বাসস্থান প্রস্তুত করেছে। শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য বাসস্থানের ভিতরেই পাথরের সাহায্যে ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে। এছাড়াও শীতকালের তীব্রতা থেকেও রক্ষা করেছে tuff’ গঠিত গুহাসদৃশ বাসস্থানগুলি যেখানে সম্পুর্ণ শীতের রসদ রাখার ব্যবস্থা। 

শত্রুর থেকে বাঁচার জন্য গুহামুখে পাথরের দরজা রাখা হত  
শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষার্থে মাটির নিচে গুহাভ্যন্তরে রসদ রাখার কুলুঙ্গী 
ঘোড়ার আস্তাবল, আঙুর থেকে রস বের করে wine বানানোর সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা, শিশুদের খেলার জায়গা সমস্তই রয়েছে। এই গভীরতায় বায়ু চলাচলের জন্য ‘air-shaft’ বা বায়ু-পথ ভূপৃষ্ঠ থেকে সর্বশেষ তলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই tuff’ থাকার জন্য রসুইঘরের ধোঁয়াও সম্পুর্ণ শোষিত হয়। সুতরাং এককথায় বলা যায় এই ভূমিরূপ এক অত্যাশ্চার্য্য সভ্যতাকে লালন করেছে।
ভূগর্ভস্থ সুরা নির্মাণ কক্ষ বা 'Winery'
ধর্মীয় কারণের সঙ্গেও এই ভূমিরূপের সম্পর্ক নিবিড়। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ও তার সৃষ্ট এই বাসস্থানের সঙ্গে জড়িত আছে ধর্মীয় উত্থান পতন। খ্রিষ্টীয় যুগের প্রথম দিকে খ্রিষ্টানুগামী জনসাধারণ ও যিশুর শিষ্যরা  রোমীয় সৈন্যদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে জেরুসালেম ত্যাগ করে আশ্রয় নেন এই ক্যাপাদকিয়াতেই। এখানকার পূর্ববসতি ও স্বাভাবিক লুক্কায়িত থাকার স্থানই তাঁদের উৎসাহিত করেছিল এখানে বসতি স্থাপনে ও পরবর্তীকালে একাধিক চার্চ তৈরিতে।
'Dark Church' যার ভিতরে 'Byzantine painting' দেখা যায় 
St. Paul এই অঞ্চলে একাধিকবার আসেন ও প্রতিষ্ঠিত করেন খ্রিষ্টান বসতি। তাঁদের এই নিরাপত্তা প্রাপ্ত হয়েছিল এই ধরনের ভূমিরূপের জন্যই। স্থানীয় ভক্ত ও সাধু সন্তরা চার্চগুলির ভিতরের দেওয়ালে অনন্যসাধারণ Byzantine painting (fresco) সৃষ্টি করেছেন। তার অসাধারন দৃষ্টান্ত এখনও পর্য্যন্ত কয়েকটি চার্চের দেওয়ালে রয়ে গিয়েছে।
উর্বর মৃত্তিকা ফল চাষের অনুকূল 
শুধুমাত্র খনিজ পদার্থ নয় ক্যাপাদকিয়ার উর্বর মৃত্তিকাও তাকে কৃষি সমৃদ্ধি দিয়েছে। মধ্যযুগে আনাতলিয়া ছিল ‘silk route’ এর কেন্দ্রস্থল। অতএব প্রতিবেশীদের সহ সুদূরের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান প্রদানও তার সমৃদ্ধির কারণ।
রাস্তার ধারে ফলের দোকান 
এখানকার কয়েকটি স্থান ভৌগোলিক কারণে গুরুত্বপুর্ণঃ
Uchisar- স্বাভাবিক দূর্গ হিসাবে এখানকার ভূমিরূপের ব্যবহার। শত্রুর আক্রমণকালে সাধারণ মানুষের দূর্গ আশ্রয় ও পরে সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্যত্র পলায়ন ব্যবস্থা।
Goreme- রোমীয় শাসনকালের গুরুত্বপুর্ণ স্থান। ‘Goreme open air museum’ প্রকৃতপক্ষে গুহাসদৃশ চার্চ fresco painting এর জন্য বিখ্যাত। খ্রিষ্টীয় শিক্ষাদান কেন্দ্র ও সাধু-সাধ্বীদের তথা শিষ্যদের বাসস্থান হিসাবেও এটি পরিচিত।
Pasabaga- স্তম্ভাকৃতি ভূমিরূপ ও তৎসন্নিহিত বাসস্থলগুলি দ্রষ্টব্য।
ভূমিরূপ বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়কার্যের ফলে নানা আকৃতি নিয়েছে যেমন উটাকৃতি ভূমিরূপ
Pigeon Valley- উপত্যকার দুই ঢাল বরাবর কোমল শিলা খোদাই করে বাসস্থান নির্মাণ ও Uchisar  দূর্গের সম্পুর্ণ আকৃতি দর্শন।
Pigeon Valley
মানুষের সাথে পায়রার সহাবস্থান

পায়রার খাবার এখানে সংগৃহীত থাকে 
Derinkuyu- এখানে খ্রিষ্টানুসারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভূগর্ভে শহর তৈরী করে, বড় চার্চ, সভা-সমিতি করার স্থান, শষ্যের গোলা, পশু-খাদ্য রাখার স্থান। বায়ু চলাচল পথ (air/ventilation shaft) সবই আছে। বর্তমানে ৮ তলা পর্যন্ত নামা যায়। এই অঞ্চলে ভূগর্ভ শহরগুলির মধ্যে এটিই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। বলা যায় সমগ্র ক্যাপাদকিয়ায় জালের মত ভূগর্ভ সুড়ঙ্গ রাস্তাগুলি ছড়িয়ে রয়েছে।

ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ 

ভূগর্ভস্থ সিঁড়ি যা মাটির নীচে এগারো তলা পর্যন্ত নেমেছে
Avanos- Kizilmak অথবা Red river থেকে স্বাভাবিক লাল রঙের মাটি, স্থানীয় চুনাপাথর, kaolin, quartz থেকে অত্যন্ত সুন্দর প্রাচীন হিট্টাইট (Hittite) পদ্ধতিতে তৈরি শিল্পকর্ম।
Avanos 'Pottery City' হিসেবেই পরিচিত তাই শহরে ঢোকার মুখে এমন স্থাপত্য কর্ম

হিট্টাইটদের মৃৎপাত্র নির্মাণের প্রাচীন পদ্ধতি, পা দিয়ে কুমোরের চাক ঘোরানো হত  
'Avanos' এ পা দিয়ে কুমোরের চাক ঘোরানো প্রক্রিয়া করে দেখানো হয় পর্যটকদের

স্থানীয় নদীর লাল মাটি থেকে নির্মিত পাত্রের রঙও লাল
আরও কিছু শিল্পকর্ম যা পর্যটকরা স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করেন

Mount Erciyes- আগ্নেয়গিরি এবং এর সন্নিহিত আগ্নেয় ভূমিরূপ দ্রষ্টব্য। 



*অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ও বিভাগীয় প্রধান 

মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পের আকারে ভৌগলিক জ্ঞান অর্জন ।

    উত্তরমুছুন
  2. "তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি"... Bhison bhison bhalo laglo, ma'am! Nijer maanoshik obosthar jonyo lekha ti chokhe porar sathe sathe porey uthte parini boley duhkshito. Afsos hochchhe lekha to etodin na porey phele rakhlam jonyo. :(
    Chhobi gulo awshadhaaron.
    Ekraash bhalobasa apnar jonyo.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা