আমার চোখে প্রকৃতির পাঠশালা


২১/১২/২০১৮
তনুজা গঙ্গোপাধ্যায়*

ট্রেনের নাম রূপসী বাংলা যাতে চড়ে পৌঁছে গেলাম প্রকৃতির পাঠশালা গড়বেতায়। কলকাতা থেকে  অনতিদূরে অরণ্য সুন্দরীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ভরে উঠল মন ঐতিহ্যের ফিল্ম সিটি তো বাড়তি পাওনা
কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক কি.মি দূরে যে এত নিবিড় প্রকৃতির সহজ পাঠ রয়েছে তা গড়বেতায় না গেলে হয়ত বুঝতেই পারতাম না। প্রকৃতির এই পাঠশালা দেখার উদ্দেশ্যে সকাল ছটা পঁচিশ মিনিটে সাঁতরাগাছি স্টেশনে পৌঁছে উঠে পড়লাম নির্দ্দিষ্ট ট্রেনে। ট্রেনে লেখা রূপসী বাংলা নাম, যেন  সুন্দর প্রকৃতিকে চোখের সামনে সাজিয়ে দিল ট্রেন শুধু খড়গপুর আর চন্দ্রকোনায় স্টপেজ দিল। চন্দ্রকোনায় ট্রেন থেকে আমরা নামলাম প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ  
স্টেশন থেকে বাসে রওনা দিলাম ফিল্ম সিটির হোটেলে। পথে পড়ল ছোট্ট কুবাই নদী। গোটা অঞ্চলটা লাল মাটিতে ঢাকা। খয়ের, বাবলা, নিম, শাল, সোনাঝুরি, মেহগনি, ইউক্যালিপটাসের বনানীরাজির মাঝের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল বাস। দূর থেকে চোখে পড়ল বিশাল অঞ্চল জুড়ে থাকা ফিল্ম সিটি। এরপর ফিল্ম সিটির রেস্টুরেন্টে টিফিন সেরে প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম শিলাবাতী নদীর উদ্দেশ্যে।           
ষাট নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে চলল বাস। পথের দুধারে শাল গাছের ঘন বন।সামাজিক বনসৃজনের উদ্দেশ্যে রোপিত হয়েছে।এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম শিলাবতী নদীর উপত্যকায় 
শালের বন 
শিলাবতী নদীর অপূর্ব সৃষ্টি ক্যানিয়ন দেখে অভিভূত হয়ে পড়লাম। নদীটি পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে বইছে। নদীটি তার ডানতীরে ক্যানিয়ন সৃষ্টি করে বাঁ তীরে সঞ্চয় করছে। নদীটি তার জীবনের মধ্যম পর্যায়ে বর্তমান। নদীটিতে নদীবাঁক নদীর বক্ষমাঝে তিনটি বালুচর সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ল। সমগ্র ক্যানিয়ন অঞ্চলটি আবহবিকারগ্রস্ত। অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পঞ্চাশ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। শিলাবতী নদী সৃষ্ট এই ক্যানিয়নকে কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে সাথে তুলনা করে বলা হয় বাংলার ক্যানিয়ন নদীটি পূনর্যৌবন লাভ করেছে।  ল্যাটেরাইট মাটি হাতে নিয়ে দেখলাম
শিলাবতী ও গনগনি 
এরপর প্রায় আড়াইটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম গনগনি গ্রামে। গ্রামের নাম গনগনি হওয়ার পেছনে প্রকৃতিরই হাত রয়েছে   প্রখর সূর্যের তেজে লাল মাটি আগুনের মতো গনগন করে ওঠে বলে গ্রামের নাম হয়েছে গনগনি  আকাশ কালো মেঘে ঢেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি  

গনগনি
গ্রামবাসীদের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে হোটেলে ফিরে খাওয়া সেরে রুমে চলে গেলাম সন্ধ্যেবেলা লাইট এন্ড  সাউন্ড প্রোগ্রাম দেখতে গিয়ে মিউজিকের তালে আলোর কেরামতি ভালোই লাগল। এরপর বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেয় কফি আর পকোড়ার সঙ্গে বসল ছোট্ট ক্যুইজ আসর
রাতের খাওয়া সারতে না সারতেই দু চোখে নেমে এল ঘুম পরের দিন সকালে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। একেই শীতকাল তার ওপর এই বৃষ্টি আরো ঠান্ডা বাড়িয়ে দিল। ফিল্ম সিটির চত্বর একটু ঘুরে দেখলাম। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম আড়াবাড়ী বনাঞ্চল গবেষণাকেন্দ্র দেখতে। 
আড়াবাড়ী বনাঞ্চল
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সর্বপ্রথম এখানেই সামাজিক বনসৃজন করা হয়। শাল, মেহগনি, অর্জুন, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাস গাছের বন। বনের নিস্তব্ধতায় গাছের পাতায় বৃষ্টির জল পড়ার শব্দে মনে হয় সবুজের এই নিশ্চুপতার সাথে মিলিয়ে দিই নিজেকে আর অবাক হয়ে দেখি সবুজের এই মনমুগ্ধকর সৌন্দর্য। তবে এইসব ইচ্ছা ওখানেই ফেলে এসে ফিরে আসি ফিল্ম সিটির প্রেক্ষাগৃহে ফাইভ ডি সিনেমা দেখে লাঞ্চ সেরে ব্যাগপত্র নিয়ে রওনা দিই বাসস্ট্যান্ডে। যেতে যেতে ক্যাকটাস জাতীয় গাছ, ধানক্ষেত দেখলাম। কোথাও ধান কাটা হয়েছে, কোথাও হবে। তবে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল অনুর্বর ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার জন্য ধান গাছের বৃদ্ধি কম। সাড়ে তিনটে নাগাদ স্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসে উঠে পড়লাম। বাস রওনা দিল কলকাতার পথে। পথে পড়ল রূপনারায়ণ। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ শ্যামবাজার পৌঁছোই। তারপর মেট্রো করে বাড়ি। এখনো যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকে সবকিছু  শিলাবতী নদী, তার সৃষ্ট ক্যানিয়ন, গনগনি গ্রাম, ফিল্ম সিটি...

*সাম্মানিক  প্রথম বর্ষ, ২০১৮

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা