২১ বছর পর…
কস্তুরী দাশ*
২১/১২/২০১৮
এইতো ! সেইবাড়ি, ‘আম্রপালী’। খুঁজে পেলাম শেষ মেষ.. গুরুপল্লীর ভেতর দিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে এসে পড়লাম সীমান্তপল্লীর মোড়ে – হাতীপুকুরের সামনে। হ্যাঁ, এবারে চিনতে পেরেছি, এই তো সেই পথ.. ডান পাশে ছিল ‘ভালো-মন্দ’ নামের সেই আড্ডাস্থল, যেখানে তড়কা, ঘুগনি, রাজমার প্লেটে হাতে মশার কামড়ে ছটফট করতে করতেও হাসি-ঠাট্টা, মজা ছিল অফুরান। আনন্দের মুহূর্তগুলো একসাথে ছবির মত মনের মাঝে চলে ফিরে
বেড়ায় থেকে থেকে। ‘ভালো-মন্দ’ অবশ্য বেশি দিন নাকি চলেনি শুনেছিলাম। সেই ফাঁকা জায়গাটা দেখে মনটা মুচড়ে উঠলো। আবার থমকাতে হলো আরে, একি! যেখানে ছোট-বড় বাড়ি ছিল সেখানে আজ 'অরশ্রী' মার্কেট, আশেপাশেও অনেক দোকানপাট।
আরে! এই তো সেই বাড়িটা, যেখানে আমি আর অনুয়া থাকতাম একসময় পেয়িং গেস্ট হয়ে। যাক বাবা, বাঁচা গেল, একদম এক আছে বাড়িটা। ফেলে আসা সময়কে আঁকড়ে ধরে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছে আজ আমার আমি। মধ্যবয়সী মন মাঝে মধ্যেই নিজেরই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় আজকাল। এই বাড়িতে গেটের দুপাশে দুটো বকফুল গাছ ছিল। মাসিমা মানে যাঁর এই বাড়িটা উনি রোজই আমাদের ভাতের পাতে
বকফুলের বড়া করে দিতেন। কি যে দারুণ স্বাদ ছিল তার!! নাহ্, এখন আর গাছ দুটো নেই দেখলাম। সবই কি পালটে যাবে!!!
![]() |
ওগো, নির্জনে বকুল শাখায় দোলায় কে আজি দুলিছে... |
![]() |
আমার মন কেমন করে |
![]() |
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ |
কলকাতা থেকে তখন সবেমাত্র গেছি। লালমাটির রাস্তা, কুয়োতলা, নানান গাছপালা, পাখির ডাক, কি ভিষন বৃষ্টি, সব কিছুতেই নিজেকে খাপখাওয়াতে পারতাম না প্রথম প্রথম। আজ এত বছর পরে সে পথে হাঁটতে গিয়ে মন খারাপের ঢেউ আছড়ে পড়ছে যেন বুকের
মাঝে। কে জানে, কিভাবে, কখন এই বিশ্ব চরাচরের অল্প দেখা কয়েকটা জায়গার মাঝে শান্তিনিকেতন
চিরস্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
কাকু বলতেন হাতিপুকুরের মোড় পেরিয়ে সীমান্তপল্লীতে ঢুকে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এসে দেখবি 'সরমা' বাড়ি, আর তার পাশের বাড়িটাই ‘আম্রপালী’। এই সেই আম্রপালী, অমূল্যকাকুর বাড়ি। মনটা খুশিতে ডগমগ করে উঠলো। দেখা হবে কাকু-কাকিমার সাথে, কিন্তু ঢুকবো কি করে?.. কাকুর বাড়িতে সব সময়ই কয়েকটি করে পোষ্য থাকতো.. আজও আছে, আর আছে তাদের প্রবল বিক্রম। ভয়ে ঢুকতে না পেরে পাশের বাড়িতে বেল দিলাম, এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলে তাঁকেই অনুরোধ করলাম কাকুর বাড়ির কাউকে ডেকে দিতে। হাসি-মুখে টুকাইদিকে বেরিয়ে আসতে দেখে স্বস্তি পেলাম যেন। আজ জানিনা কেমন যেন দিনটা, একদিকে সব কিছু হারিয়ে ফিরে পাওয়া অপরদিকে পেয়ে হারানোর বেদনা। টুকাইদি হাত ধরলো আমার বললো “কিছু মনে করিস নারে নামটা না ঠিক…” আমি মনে করলাম, তারপরই বললো, “জানিস মা চলে গেছে ২০০৭ তে আর বাবা শয্যাশায়ী”।
কি বলছে টুকাইদি! সবকিছু যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। অনেক অনেক দেরি করে ফেললাম বুঝি… বিছানায় বন্দি, প্রায় অচেতন, পার্থিব চেতনার জগৎ থেকে অনেক দূরে যে মানুষটা বিছানায় শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, উনি আর কেউ নন; আমার সেই প্রিয় কাকু, একদা আমার লোকাল গার্জেন অমূল্য কাকু। ওনার স্নেহপরশ না থাকলে আমি পড়তেই পারতাম না শান্তিনিকেতনে। সে অনেক কথা, অন্য কোনো সময় সে গল্প তুলে ধরবো।
কাকু বলতেন হাতিপুকুরের মোড় পেরিয়ে সীমান্তপল্লীতে ঢুকে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এসে দেখবি 'সরমা' বাড়ি, আর তার পাশের বাড়িটাই ‘আম্রপালী’। এই সেই আম্রপালী, অমূল্যকাকুর বাড়ি। মনটা খুশিতে ডগমগ করে উঠলো। দেখা হবে কাকু-কাকিমার সাথে, কিন্তু ঢুকবো কি করে?.. কাকুর বাড়িতে সব সময়ই কয়েকটি করে পোষ্য থাকতো.. আজও আছে, আর আছে তাদের প্রবল বিক্রম। ভয়ে ঢুকতে না পেরে পাশের বাড়িতে বেল দিলাম, এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলে তাঁকেই অনুরোধ করলাম কাকুর বাড়ির কাউকে ডেকে দিতে। হাসি-মুখে টুকাইদিকে বেরিয়ে আসতে দেখে স্বস্তি পেলাম যেন। আজ জানিনা কেমন যেন দিনটা, একদিকে সব কিছু হারিয়ে ফিরে পাওয়া অপরদিকে পেয়ে হারানোর বেদনা। টুকাইদি হাত ধরলো আমার বললো “কিছু মনে করিস নারে নামটা না ঠিক…” আমি মনে করলাম, তারপরই বললো, “জানিস মা চলে গেছে ২০০৭ তে আর বাবা শয্যাশায়ী”।
কি বলছে টুকাইদি! সবকিছু যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। অনেক অনেক দেরি করে ফেললাম বুঝি… বিছানায় বন্দি, প্রায় অচেতন, পার্থিব চেতনার জগৎ থেকে অনেক দূরে যে মানুষটা বিছানায় শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, উনি আর কেউ নন; আমার সেই প্রিয় কাকু, একদা আমার লোকাল গার্জেন অমূল্য কাকু। ওনার স্নেহপরশ না থাকলে আমি পড়তেই পারতাম না শান্তিনিকেতনে। সে অনেক কথা, অন্য কোনো সময় সে গল্প তুলে ধরবো।
![]() |
তবু মনে রেখো... |
“মন চলো নিজ নিকেতনে…”- আজ আর থামলে চলবে না, এখনো অনেকটা পথ বাকি; এগোলাম ‘বালি-পাড়া’ র দিকে। একটা ছোট সাঁওতাল গ্রাম। ওই সীমান্তপল্লীতে আর একটি বাড়িতে আমি আর অনুয়া থাকতাম, বাড়ির নামে ‘সূর্যাবর্ত’। ওই বাড়ি ছিল মমতা কাকিমার, ওনার তৈরি কাঁথার স্টিচের শাড়ির কদর ছিল খুব। টুকাইদির মুখে শুনলাম উনিও অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ওই 'সূর্যাবর্ত' বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে এলেই ছিল ‘বালি-পাড়া’। তখন ওই পাড়া প্রকৃত অর্থেই সাঁওতাল পাড়া ছিল।ছোট ছোট মাটির বাড়ির দেয়ালের রঙিনফুল- লতা-পাতা আঁকা থাকতো। গাছে গাছে সাদা বড় বড় শিম ঝুলত। নানান নাম না জানা ফুলে সুসজ্জিত হয়ে থাকতো গোটা পাড়াটা, আর ছিল সেই পাড়ার মানুষ গুলো ওদের অকৃত্রিম হাসি, মেঠো চেহারা, কারাম উৎসবের নাচের ভঙ্গিমা গুলো সব-সব, মনে পড়ে গেলো।কিন্তু, একি! এ পাড়া তো সে পাড়া নয়!! মাটির বাড়ি একটা দুটো থাকলেও দোতলা পাকা বাড়িই বেশি দেখলাম। সেই সব ফুল-গাছপালা কোথায় গেল সব…
লাল-মাটির পথ হারায়নি, হারিয়েছে সেই মাটি মাখা মানুষ আর তাদের মন, তাই এমন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে সব। আমারও কি কম বদল হয়েছে… এক্কেবারে আমূল বদলে গেছি আমি, আমার দেখার চোখ, ভাবনা, মন সব কিছু। তাই হয়তো আজ এমনটা হচ্ছে, মিল খুঁজে পাচ্ছিনা কোনো কিছুতেই। অচেনা কে চেনা হয়ে গেলে চেনা অচেনার দ্বন্দ্ব মেটে, কিন্তু দেখা আর অদেখার মাঝে যে সময় বহমান, সেই সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ দীর্ঘ ২১ বছর পর ফিরে দেখতে গিয়ে চোখ ঝাপসা
হয়ে যাচ্ছে বার বার।
কথা দিলাম--- সীমান্তপল্লী, বালি-পাড়া, লক্ষী-নারায়ণবাড়ি, কুয়োতলা, ঘাস-ফড়িং, ছাতারে পাখি, কুর্চিফুলের গাছ তোমাদের ছুঁয়ে থাকবো আমি, আর ২১ বছর দেরি করবো না আসতে। মনের রুক্ষ-মাটিতে অনেক অনেক দিন পর আনন্দের বারিধারা। এক বুক ভিজে-সোঁদা-আরামের গন্ধ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি আমি। আবার ফিরে আসবো তোমাদের কাছে শিগগিরি, কথা দিলাম।
![]() |
আসন আপন হাতে পেতে রেখো আঙিনাতে... |
![]() |
এ পথে আমি যে গেছি বার বার... |
ভালো থেকো।
*প্রাক্তনী, ১৯৯৪
Khub sundar likhechho Kasturi
উত্তরমুছুন