সুন্দরবনের সৌন্দর্যায়ন


২১/১২/২০১৮
রিয়া মালিক *

তখন আমার বয়স ১৬, সময়টা ছিল ২০১৬, ১৭ ডিসেম্বর তখন আমি কলকাতার  স্যার নৃপেন্দ্রনাথ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি আমাদের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের ওই বছর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দঃ ২৪ পরগনার সুন্দরবনঞ্চলেজীবনে প্রথম বন্ধুদের সাথে ভ্রমণ এই কথাটা ভেবেই মনের ভেতর একটা কেমন অনুভূতি গড়ে উঠেছিলঅপেক্ষা করে চলেছিলাম সেই দিনটার জন্য অবশেষে এল সেই দিনটি 
সকাল:৩০ শিয়ালদহ স্টেশন এসে পৌঁছালাম মনের ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা :৩০ ট্রেনটি স্টেশনে এলে একে একে সবাই উঠে বসলাম :৪৫ নাগাদ ট্রেনটি চলতে শুরু করল, মি: অন্তর একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে ট্রেনটি যখন ঘুটিয়ারি শরিফ এসে পৌঁছালো তখন চারিদিকে শহরের কোলাহল ব্যস্ততার অবসান ঘটে সম্পুর্ণ একটি গ্রামের চিত্র তৈরি হয়েছে  দিগন্তজোড়া মাঠ, মাঠে গরু চড়ছে, খোলা আকাশ, পথে পদ্ম প্রস্ফুটিত কত জলাশয়, ধানের গোলা দূর দুরান্তে, একটি দুটি মাটির বাড়ি এইসব দৃশ্য মনকে আপ্লুত করেছিল এইভাবেই প্রায় ১৬ টি স্টেশন পেরিয়ে ট্রেনটি ক্যানিংএ এসে পৌঁছালো প্রায়:৩০ নাগাদ
ক্যানিং থেকে গাড়ি  অবধি হেঁটে যেতে প্রায় ২০-২৫ মিনিট মতো সময় লাগল স্ট্যান্ড থেকে আমরা ওখানকার প্রচলিত ম্যাজিক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে বসে কোনও রকমে গদখালি পৌঁছালামযেতে যেতে গাড়ির ড্রাইভার মাতলা নদী, হোগল নদী, দূর্গাদুয়ারী নদী, বিদ্যাধরী নদী, গোমর নদী  দেখালেন; কত নদী শুকিয়ে গেছে পলি ভরে, কোনটাতে আবার জল ভরপূর গদখালিতে পৌঁছে ওখানকার একটি বিশ্রামাগারে বিশ্রাম নিয়ে লঞ্চ আসাতেই উঠে বসলাম,লঞ্চ চলতে শুরু করল খানিক বাদে গরম গরম ফুল্কো লুচি আলুরদম দিয়ে প্রাতরাশ করা হল আমাদের শিক্ষিকা বিভিন্ন নদী, দ্বীপ, খাঁড়ি দেখালেন সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার বিভিন্ন নদীর জলের বিশেষত্ব, কোনওটার রং হালকা হলদেটে, কোনওটা আবার ধবধবে সাদা চারিদিক গাছের ছায়া পরে কিছু নদীর জল অবশ্য সবুজ দেখাচ্ছিল
খাঁড়ি
ইতিমধ্যেই কুমিরবাবাজির সাফাৎ পাওয়া গেলএভাবে লঞ্চ মাঝনদীতে পৌঁছালো খাওয়া দাওয়া তখন সব ভুলেই গেছি, লঞ্চ থেকে নেমে নৌকা করে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম পরিদর্শনে চলতে লাগলাম এক অজানা গ্রামের সন্ধানে নৌকা খানিকটা যাওয়ার পরে মাঝি বললেন নৌকা আর এগোনো যাবেনা ভাঁটা পরে গেছে বললেন আমাদের সকলকে কাদা পেরিয়ে গ্রামে যেতে হবেপ্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও একবার কাদায় নামার পর অনুভূতিটাই অন্যরকম তৈরী হল নদীর ভাঁটা পড়া উপত্যকায় মাটির রং হলদেটে তার মাঝেমাঝে গাছ গাছালি বাণী, গেঁওয়া, গরান গাছে কুমিরের দাঁতের মতো খোঁচা খোঁচা শাসমূল, ঠেসমূল সব নিজের চোখে প্রদর্শন করলাম অনেকের অবস্থা তো শোচনীয় হয়ে উঠেছিল, জামা কাপড়ে মাটি, কাদা লেগে একাকার হয়ে গিয়েছিল
কুমীর 
লবণাম্বু উদ্ভিদ
 স্বাভাবিকভাবে এক যুদ্ধ করে পৌঁছালাম গ্রামের নাম 'চরঘেরি' এটি সুন্দরবনের সবথেকে শেষের গ্রাম, এরপর জঙ্গলে ঢাকাগ্রামের বাড়ি সব মাটির, কোনওটা আবার দোতলা মাটির বাড়ি, চারিদিক সবুজ গাছ, কাঁচা মাটির পথ ধান, সব্জির চাষ, গরু মোষ পালন, মাছ চাষ, জেলে, বৃষক এইসবই ওখানকার প্রধান জীবিকা লোকজনকে জিজ্ঞেসা করে জানতে পারলাম সুন্দরবনের বাঘ বিগত বছর ওই গ্রামে এসেছিলসামনে একজনকে পেয়ে মেরে ফেলেছে তাই ওখানকার লোকেরা সন্ধ্যার পর আর ঘর থেকে বেরোয় না সারাদিনটা গ্রামে কাটানোর পর যখন নদীর তীরে এসে পৌঁছালাম ততক্ষণে প্রায় ভুলেই গিয়েছি যে নদী তে আবার কাদা পার হয়ে নৌকায় উঠতে হবে।তবে কী আর করা যাবে রীতিমতো আবার কাদা মেখে আধ বরাবর যাওয়ার পর নৌকায় উঠলাম।
আমরা
নৌকা আমাদের মাঝ নদীতে লঞ্চেছেড়ে এলে লঞ্চে উঠে একটু আশ্বস্ত হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম।তখন বাজে ৫:৪৫,চারিদিকে আস্তে আস্তে সন্ধ্যের আগমন ঘটেছে। খোলা আকাশ, নীল নদী, আকাশ ভর্তি তারা। দু একটা লঞ্চের ঝিকিমিকি করা আলো তারই মাঝে দাঁড়িয়ে, যেন মনে হচ্ছিল এই তো স্বর্গ। সন্ধ্যা একটু গাঢ় হতেই গরম গরম পকোড়া মুখের সামনে আনা হল মনে মনেভাবলাম ভালই জমবে।
:৩০ নাগাদ লঞ্চটা একটা খেয়া ঘাটের সামনে এসে দাঁড়ালো, জায়গাটা হল পাখিরালয় জানা গেল এখানেই কোনও এক হোটেল আমাদের রাত অতিবাহিত করতে হবে। সেখান থেকে ৫-১০ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছালাম সেই হোটেলের সামনে। সেইদিন ৯:৩০ নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে যে যার মতোঘুমিয়ে পরব সে তো শিক্ষিকারা ভেবেছিলেন; কিন্তু ঘুম যে আসতে চাইছিল না। আমরা সবাই মিলে গানের লড়াই, কুইজ ইত্যাদি খেলা আরম্ভ করে দিলাম। ১২:৩০ নাগাদ প্রত্যেকে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ম্যানগ্রোভ
পরের দিন সকালে উঠে দেখতে পেলাম চারিদিকে কত রকমের পাখি, কোনোটা হলুদ, কোনওটা সবুজ, কোনওটা খয়েরি, কোনওটা আবার কালো, রঙের যেন ঘনঘটা।সকালে প্রাতরাশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম ঝড়খালিতে লঞ্চে করে  ওখানকার একটি মিউজিয়াম ঘুরে দেখলাম। লঞ্চ থেকে নেমে ওই মিউজিয়ামে ঢোকার পথে দেখলাম লাল কাঁকড়া, বাঁদর। মিউজিয়ামের ভিতরে সুন্দরবনের মানুষদের জীবন যাত্রার বিভিন্ন মূর্তি পরিদর্শন করলাম। ওখানে রাখা সত্যিকারের বাঘের ছাল পড়ানো পাথরের তৈরি বাঘ মূর্তি দেখলাম। মিউজিয়াম থেকে বেরোনোর পথে দেখলাম বনবিবির মন্দির আরও কত কী, আকর্ষণীয় বিষয় দেখলামএটি নাকি বাঘের প্রিয় আস্তানা।
কাঁকড়া
এত কিছু দেখার পরও মনের ভিতর খানিকটা হতাশা ও আক্ষেপ নিয়ে লঞ্চে উঠে পড়তেহল। যেতে যেতে দেখতে পেলাম প্রজাপতি বাগান। সবার হৃদয় একটা হতাশার ছাপ আস্তরন যখন ফেলেছে ঠিক সেই সময় ভয়ানক গর্জন শোনা গেল আমাদের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কে, শিহরনের সাথে চিৎকার করে উঠলাম মনের ভেতর  ততক্ষণে সব মেঘ সরে গিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এত উত্তেজনার মধ্যে দুরভাগ্যবশত বাঘের একটা ছবি তুলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলামতবে সেই দৃশ্য সারাজীবন মনের ক্যামেরায় বন্দি হয়ে রইল। এরপর লঞ্চে জলপথ অতিক্রম করে খেয়া ঘটে পৌঁছাল।ম্যাজিকগাড়ি করে ক্যানিং এ পৌঁছালাম, ট্রেন ধরে ক্যানিং থেকে সোজা শিয়ালদহ।
এই ভ্রমনের অভিজ্ঞতা এক অদ্ভুত রোমাঞ্ছকর স্মৃতি হিয়ে মনের মধ্যে সারাজীবন গেঁথে রইল।

*সাম্মানিক  দ্বিতীয় বর্ষ, ২০১৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হিমালয়ের কঠিন ট্রেক; জংরি-গোচা লা

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

অপেক্ষা