সবুজ শৈশব সবুজ ভাবনা



১৯/১০/২০১৭

আয়েশা সুলতানা*

১৮নং পার্কসার্কাস রোডের তেতলা বাড়িতে সকাল শুরু হয় পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে তিয়ার প্রশ্নপর্ব দিয়ে ছোট্ট মেয়ে রোজ নতুন নতুন ভাবে পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করছে একটু একটু করে তার প্রশ্ন শুনে বাবা মাও বুঝে উঠতে পারেনা যে এত প্রশ্ন কোথা থেকে আসে?   ক্লাস টিচারের কাছ থেকে নালিশ আসে তিয়া ইজ ভেরি টকেটিভ গার্ল হিসাবে এখানেই শেষ নয়,  হাতে একটা পেন্সিল নিয়ে তিয়া দেওয়ালকে বলবে, “ কি অঙ্ক হল! অঙ্ক করতে এতক্ষণ লাগে?“ টেবিলকে বলবে, “আবার কথা বলছকথা বললে, কান ধরে বের করে দেব এখনও অঙ্ক হলনা ওখানে কে? ও তুমি !”  আসলে তিয়ার নজর তখন পাখাটার দিকেপাখাটিকে বলবে , “কাল আসনি কেন! পেটব্যাথা!  দরখাস্ত করতে বলবে তোমার বাবাকে বলবে মিস বলেছেন  মাঝে মাঝে তিয়ার বাবা পেছন থেকে চুপিচুপি এসে দাঁড়িয়ে এই সব দেখে হো হো করে হেসে ওঠেন তারপর বাবা মেয়ের প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু স্কুলে সারাদিন কি হয়েছে? মা কতবার বকা দিয়েছে, আর কি কি দুষ্টুমি করা হয়েছে এ সকল খুঁটিনাটি দুষ্টু মিষ্টি গল্প প্রায়শই চলতে থাকে অফিস থেকে ফিরেই চা খেতে খেতে তিয়ার মা, অনিতা স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন, তিয়ার স্কুলের ম্যাডামরা আজকাল কি সব কাজ করতে দেয়, এতো বাবা মায়েদেরই হোমওয়ার্ক যেন তিয়ার বাবা নিখিল স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন, কি হোমওয়ার্ক?”  অনিতা অল্প বিরক্তির সুরে বলল, আর বলনা, একস্ট্রাকারিকুলার একটিভিটিতে গ্রেড এ পেতে হলে কিছু ভালো চারাগাছ কিনে বাচ্চাদের দিয়ে বাগানে বা পার্কে লাগাতে হবে তারপর ফিডব্যাক দিতে হবে, এই সব না করিয়ে কোনো কম্পিউটার স্কিল শেখালে ভালো হতো কিনা তুমি বলো, কে যে এদের এইসব করার কথা সাজেস্ট করে বুঝিনা কলকাতা শহরে কার অত সময় আছে শুনি?”
নিখিল অন্যমনস্কভাবে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে,  আমি না হয় কাল অফিস ফেরার পথে নিয়ে আসবো অনিতা সারাদিনে দুবার ফোনের মধ্যে নিখিলকে মনে করিয়ে দিল চারাগাছ আনার কথা অফিস ছুটির পর কলিগের সাথে আড্ডা শেষ করে গুগলের ম্যাপ সার্চ করে নিউটাউন রাজারহাটের 'পিয়ালী' নার্সারীতে গিয়ে গুটি কতক চারাগাছ নিয়ে দাম মিটিয়ে নার্সারীর বাইরে যেতেই নিখিল দেখল  একটা ট্যাক্সি দাড়িয়ে আছে না, এই ট্যাক্সি বাকি পাঁচটা সাধারণ ট্যাক্সির মত নয়, একটু আলাদা ধরনের ট্যাক্সির উপরের ছাদের জায়গাটা কৃত্রিম ভাবে মাটির স্তর ছড়ানো, তার উপর কতকগুলো গাছ ও হরেকরকম ফুলের চারাগাছ লাগানো অবাক হয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকে নিখিল। খবরের কাগজে পড়েছিল একদিন এই অভিনব ট্যাক্সির কথা ট্যাক্সির কাছা কাছি গিয়ে ভালো করে খুঁটিয়ে অভিনব সবুজ যানটিকে দেখছে এমন সময় পিছন থেকে একজন ভদ্রলোক, ট্যাক্সি ড্রাইভার বললেন, উঠবেন দাদা আমার গাড়ীতে?” নিখিল এই সুযোগ হাতছাড়া না করে এক কথায় উঠে বসে বলল, পার্কসার্কাস ড্রাইভার দাদা হাতে থাকা সদ্য কেনা সার, চারাগাছ পাশে সরিয়ে রেখে গাড়ী স্টার্ট দিলেন কিছুক্ষন পর নিখিল ড্রাইভার দাদাকে বলল, আপনার এই সবুজ যানের কথা খবরের কাগজে পড়েছি, আজ সওয়ারি হতে বেশ ভালো লাগছে  ড্রাইভার দাদা হেসে বললেন, হ্যাঁ আমার গাছপালার খুব সখ, ছোট থেকেই বংশগত সূত্রে এই নেশার প্রাপ্তি ছোটবেলা থেকেই হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম দাদুকে গাছ লাগাতে দাদু খুব উৎসাহ দিতেন ভালোবেসে আমাকে মাঝে মধ্যেই বলাই বলে ডাকতেন একদিন কথায় কথায় এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় দাদু রবীন্দ্রনাথের লেখা 'বলাই' পড়তে দিয়েছিলেন। গাছপালা লাগানো আমার নেশা বলতে পারেন, ভালোবাসি এই আর কি কলকাতা থেকে তো সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে একেবারে, তাই আমার এই ছোট্ট প্রচেষ্টা নিজের শখ পালন আবার আরো পাঁচটা মানুষকে সচেতন করা, এক ঢিলে দুই পাখি
গাড়ির  পিছন দিকে থাকা একটি টবের ভিতর নয়নতারা গাছের ছোট্ট আধফোঁটা কুঁড়ির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো নিখিল মন দিয়ে শুনছিল সে ভাবছিল,  সত্যি আমরা কজন শহুরে মানুষ সবুজ প্রাণ নিয়ে ভাবি,  না তাদের যত্ন নিই,  না শিক্ষিত সচেতনদের মত আচরণ করি শুধুমাত্র  একটি গাছ একটি প্রাণ”, রচনা লিখে নম্বর প্রাপ্তির মধ্যে, আমাদের পরের প্রজন্মকে তথাকথিত   'এ গ্রেড'  পাওয়ানোর মত ছোট্টো আবদ্ধ চিন্তার মধ্যেই সীমিত ধ্যানধারণা নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলেছি কোনো এক অজানা পারফেকসন এর মাইলস্টোন অ‍্যচিভ করার উদ্দেশ্যে ভাবনায় কাঁচি পড়লো যখন ড্রাইভার দাদা ব্রেক কসে বললেন, পার্কসার্কাস চলে এসেছি ট্যাক্সির ভাড়া সহ আর কিছু পরিমাণ টাকা এমনিই দিল নিখিল সুন্দর মুহূর্ত, ভাবনা, অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে নিখিল সবুজ যান ও ড্রাইভার দাদার সাথে সেলফিও তুললো না সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করার জন্য নয়, তার ছোট্ট তিয়াকে দেখানোর জন্য  বাড়ির কলিং বেলের আওয়াজ শুনে অনিতার পিছন পিছন তিয়া ছুটে আসল দরজায় এবং নিখিলের হাতে থাকা চারাগাছ গুলিকে কেন্দ্র করে জিজ্ঞাসিত চোখে আবার যাবতীয় প্রশ্নের ভান্ডার  খুলে গেল হ্যাঁ, নিখিল পুরো ঘটনাটা বলবে তিয়াকে, কারণ সে বুঝেছে, আমরা বড়রা ছোট্ট বাচ্চাগুলিকে একটু করে খোলা আকাশ দিতে পারিনা, পারিনা নিজের মত কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীন সময়টুকু ছোট্ট বাচ্চারা অনেক কিছু দেখতে পারে ভাবতে পারে, বুনতে পারে অনেক দৃশ্য কল্পনা দিয়ে, তাদের ভাবনা চিন্তা মানে না কোনো দেশের সীমানা তারপর সময়ের সাথে সাথে যত বড়ো হয়,  সেই সব কল্পনা ধামা চাপা পড়ে যায়, কঠিন বাস্তব তার ধুলো মাখা কার্পেটের আস্তরণে 


*সাম্মানিক প্রথম বর্ষ, ২০১৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়