শিলং স্মৃতি



১৯/১০/২০১৭
পারিজাত ঘোষ*

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী
গিরি-সিন্ধু-মরু,
কতনা অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার আগ্রহ মানুষের চিরকাল। তাই অজানাকে জানার, আর অছেনাকে চেনার জন্য মানুষ বেড়াতে যায়। ভ্রমনের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে মধুর। বর্তমান যুগে দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্র্যহীন একঘেয়েমিতে মন যখন অবসন্ন হয়ে পড়ে তখনই মানুষ বৈচিত্ত্র্যর আকর্ষণে মনে প্রাণে উৎসাহ মেশাতে ভ্রমণের তাগিদ অনুভব করে। ভ্রমনের মাধ্যমে সংকীর্ণতা ও মানসিক জড়তা দূর হয়। তাই যেকোনো ভ্রমনের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম।
গত বছর I.S.C.  পরীক্ষার পর আমরা শিলং বেড়াতে জাই। তার স্মৃতি আজও আমার স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে আছে। সরাইঘাত এক্সপ্রেসে আমরা রওনা হয়েছিলাম। প্রথম যাই গৌহাটি। সেখানে ছিলাম একদিন। কামরূপ কামাক্ষা দর্শন করি। তারপর নৌকো করে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ভ্রমণ করেছি। অপূর্ব তার দৃশ্য। চারিদিকে জল, মাঝখানে ছোট এক্তা দ্বীপের মত। গৌহাটিতে আরও কিছু দেখার আছে। যেমন নবগ্রহ মন্দির, বশিষ্ঠমুনির আশ্রম, মাছের জাদুঘর, বালাজীর মন্দির ইত্যাদি। ওখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বিহু, যা আমরা উপভোগ করেছিলাম।
পরেরদিন আমরা টাটাসুমো করে শিলঙের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শিলঙের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। বাঁদিকে চলেছে ঢেউ খেলানো পাহাড় আর জঙ্গল, ডানদিকে সবুজ ধানক্ষেত। এই দুয়ের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে পিচ বাঁধানো চওড়া রাস্তা। নেই বিশাল খাদ। অবশেষে বেলা ১১ টার সময় আমরা শিলং পৌঁছলাম। সেখানে শিলং রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্টহাউসে আমরা ছিলাম। অপূর্ব তার মহিমা। অদ্ভুত সুন্দর সেখানকার মনোরম পরিবেশ যা আজও আমাকে বার বার টানে। বিকেলে গাড়িতে করে শিলং গলফকোর্সে গেলাম। যতদূর চোখ যায় সবুজ ঘাসে ভরা অন্তহীন এক সমুদ্র। তারই মধ্যে ঢেউয়ের ফেনার মত সাদা জামা পরা বলবয়দের দৌড়। তারপর গেলাম শিলং পিক দেখতে। রেলিং বাঁধানো প্রায় সমতল পাহাড়ের চূড়া, শিলঙের সবচেয়ে উঁচু ভিউ পয়েন্ট। দূরে দেখা যায় শিলং শহর। খেলনার মত ছোট ছোট বাড়ি, ছোট ছোট বাগান। সেখানে দাঁড়িয়ে শেষের কবিতার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। সেই অমিত রায় আর তার প্রেমিকা লাবন্যর কথা; সে লাবন্যকে বলেছিল, “আমার বাড়ি হবে নদীর এপারে আর তোমার ওপারে।“ শিলং পাহাড়েই তাদের মোটর গাড়ির ধাক্কা হয়েছিল।
মেঘেদের বাড়ি


শিলং এর কাছেই চেরাপুঞ্জি, পরদিন টাটাসুমোতে করে আমরা চেরাপুঞ্জি রওনা হলাম। সেখানে সবসময়ই বৃষ্টি, কিন্তু আমরা এতটাই ভাগ্যবান সেখানে মেঘ, রোদ্দুর আর বৃষ্টি তিনটেই পেয়েছি। তার সঙ্গে অনুপম ঝর্ণা। একপাশে গভীর খাদ সেখান থেকে মেঘেদের উঠে আসা আর আমাদের হাতছানি দেওয়া। চেরাপুঞ্জিতে সেভেন সিস্টার ফলস, মস্খাই কেভ, চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশন এই সবকিছুই যেন আমার মনের মণিকোঠায় রেখাপাত করে গেছে। মন ভরে গিয়েছিল এই অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। কবি যতীন্দ্রনাথ সে্নগুপ্ত এই চেরাপুঞ্জি সম্বন্ধে লিখেছিলেন “চেরাপুঞ্জি থেকে একখানা মেঘ ধার দিতে পারো সাহারা মরুভূমির বুকে।“
শিলঙের শোভা

চেরাপুঞ্জি থেকে আমরা ফিরে আসি আবার শিলং রামকৃষ্ণ মিশনে। সন্ধ্যাবেলায় সেখানের সন্ধ্যারতি রামকৃষ্ণ মিশন আমায় মুগ্ধ করে। পরেরদিন রওনা হই ডাওকির পথে। সেখানকার living root bridge  অর্থাৎ গাছের শিকড়ে বাঁধা ঝুলন্ত সেতু প্রায় কুড়িতলা বারির নীচে তৈরি হয়েছে। পাহাড়ের এবড়ো খেবড়ো পথ বেয়ে সেখানে নামি। ঝুলন্ত সেতুর নীচ দিয়ে গম্ভীর গর্জনে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝর্ণা। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল ভগবানের কি অপূর্ব সৃষ্টি। যার এই পরম সৌন্দর্য আর মাধুর্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
ঝুলন্ত সেতু

ডাওকির আর একটা বড় আকর্ষণ এশিয়ার cleanest village অর্থাৎ ওই পাহাড়ের কোলে সবুজে ঘেরা এত পরিষ্কার ছোট একটা গ্রাম। সেখানকার মানুষগুলোর মধ্যে রয়েছে অসম্ভব আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা।
ঝরনা

এরপর বাড়ি ফেরার পালা। আবার শিলং থেকে গৌহাটি ফিরে এলাম। মন চাইছিল না কিন্তু আমরা তো নিয়মের দাস। সারা মন জুড়ে শুধুই শিলং এর স্মৃতি যা আজও আমায় উদ্দীপ্ত করে, উল্লসিত করে, পাইন গাছের মৃদু দোলার কথা মনে পড়লে আমার গায়ে তার শিহরণ জাগে আজও। ঝর্ণার সৌন্দর্য, অপরূপ মাধুর্য আমার স্মৃতিতে আজও সঞ্চিত হয়ে আছে। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয় ওখানকার মানুষ, জল, তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আচার ব্যবহার, লোকসংস্কৃতি সবই আমার স্মৃতির সঙ্গে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে। তাই এই ভ্রমণের স্মৃতি আমার কাছে চিরজাগরুক এবং এর অভিজ্ঞতা আমার জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে। 


*সাম্মানিক  প্রথম বর্ষ,  ২০১৭


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়