অমরকন্টকের পথে

০৯/০৯/২০১৬

মৌসুমী ব্যানার্জী

এবার বেরোনটা অপ্রত্যাশিত ভাবে হয়ে গেল। ভোরবেলা ঠিক হল আগামীকালই বেরোন যাক। গন্তব্য অমরকন্টক। ব্যস্, দুপুরের আগেই ট্রেনের তৎকাল reservation. Sleeper class র ১টি মাত্র lower berth এবং ২টি waiting list ticket নিয়ে পরেরদিন রবিবার দুপুর 12.05 এ ট্রেন।

আমার ঠিকানা উড়িষ্যার বেলপাহাড়, স্বামীর কর্মসূত্রে। মফস্বল শহর।কোয়ার্টার থেকে ১৫/২০ মিনিট দূরত্বে রেলস্টেশন, বেলপাহাড়। হাওড়া - মুম্বাই গামী সব ট্রেনেরই এই পথেই যাওয়া আসা। সময় মতো আমরা স্টেশনে পৌঁছলাম। ছোট্ট স্টেশন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বড় বড় গাছপালা ঘেরা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ, বাদামী পাহাড়, নীল আকাশের উঁকিঝুঁকি। মার্চের দুপুরেও সুন্দর, মিঠে হাওয়া। শান্ত প্ল্যাটফর্মের আনাচে কানাচে নিশ্চিন্তে কয়েকটি কুকুর নিদ্রায় মগ্ন। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। ট্রেন আধঘন্টা লেট। কোই বাত্ নহী। আমার মধ্যে সেই 'পথের পাঁচালি'র 'হাঁ করা ছেলেটা' মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়। তখন মনটা যাই দেখে তাই দেখতেই থাকে।

রোদ তো অনেকদিনই এমন ঝলমল করে ; সাদা সাদা মেঘের দলও এমনভাবে অনেক সময়ই নীল আকাশের মাঝে মাঝে আড্ডা জমায় অথবা দূরের পাহাড়গুলোর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে ; আর হাওয়াতে পাতার সড়সড়ানি শব্দ? কি আর এমন ব্যাপার! সেই 'হাঁ করা ছেলেটা' যেন বলে উঠল , ভাগ্যিস! ট্রেনটা একটু দেরী করল! যাই হোক। ট্রেন এল। দারুণ সুখবর! Side lower berth এ আমি জায়গা পেয়েছি! এরপর ঐ berth ই আমার কয়েকঘন্টার ঘর, সংসার পৃথিবী। পাশের খোলা জালনা দিয়ে দেখে মনে হল, সত্যিই পৃথিবীটা বড়ই সুন্দর! বিলাসপুর ছাড়ানোর পর প্রকৃতি সৌন্দর্য্যকে উজাড় ক‍রে দিল। রেললাইনের দুপাশে পাহাড় আর শালের জঙ্গল। জালনা দিয়ে দেখলাম ট্রেনের সামনের অংশ পুরো বেঁকে শালবনের ভিতরে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি এল। ভিজে মাটির গন্ধে মন মেতে উঠেছে তখন। অচানকমারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে।শালবনে নতুন, সবুজ পাতা, আকাশে ছাইরঙা মেঘ। বাইরের পৃথিবীকে গোগ্ৰাসে গিলছি তখন।

সন্ধ্যের মুখে পৌঁছলাম পেণ্ড্রা রোড জংশন স্টেশনে। বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ গুড়গুড় করছে।গাড়ি ঠিক হল। রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই শালবনের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের রাস্তা। ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে ভিজে মাটির গন্ধ। এক অজানা পৃথিবী যেন। গাড়ির হেডলাইটকে ভরসা করে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছলাম অমরকন্টক। বিন্ধ্য, সাতপুড়া ও মৈকাল পর্বতের মিলনস্থল অমরকন্টক। নর্মদার উৎসস্থল এখানেই। সতীপীঠ অমরকন্টক। রামায়ণ, মহাভারত, মার্কণ্ডেয় পুরাণ এমনকি কালিদাসের মেঘদূতেও পাওয়া যায় এখনকার এই মফস্বল শহরটির নাম। বহু পৌরানিক মুনি, ঋষিদের সাধনস্থল ।

রাতটা কম্বলের তলায় কাটিয়ে পরদিন সকালেই বেরনো হল নর্মদা কুণ্ড ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের উদ্দেশ্যে। নর্মদা কুণ্ড - নর্মদা নদীর উৎস। মোটামুটি দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে কলচুড়ি রাজাদের সময় এই উদ্গম কুণ্ড আবিষ্কার হয়। এরপর এই কুণ্ডকে ঘিরে তৈরী হয় নর্মদা মায়ের মন্দির। সেই মন্দির কালের গর্ভে বিলুপ্ত হয়। পরবর্তীকালে মধ্যপ্রদেশের রেবার মহারাজ গুলাব সিং সংস্কার করান।


কুণ্ডটিকে ঘিরে রয়েছে মোট ২৭ টি মন্দির। এই মন্দিরের ১০০ মিটার দূরেই আছে আরও একটি মন্দির complex, কলচুড়ি রাজাদের অপূর্ব স্থাপত্যকীর্তি, যা ভারতের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। এখান থেকে ১ কি.মি. দূরে মায়ী কি বাগিয়া ( মায়ের বাগান) , অন্য নাম চরণোদক কুণ্ড। এই বাগানটিতে আছে নানা প্রকারের ওষধি বৃক্ষ। বাগানের গাছপালা অবশ্য বিশেষ চেনা গেল না।


কপিকুলের ভীড় সামলে কোনোরকমে গাড়িতে গিয়ে বসলাম, তাও কাঁচ বন্ধ করে। এরপরের গন্তব্য শোনমুড়া। শোন নদের উৎসস্থল। স্থানীয় নাম 'শনেমারা'। সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা নেমে বাঁধান কুণ্ড। কয়েক হাত দূরে আর একটি কুণ্ড। ভদ্রকুণ্ড। এই দুই কুণ্ডের জলের মিলিত প্রবাহ শোনভদ্র নদ, যা ১৫০ মিটার দূরে পাহাড়িখাত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দূরে কোনোও এক জায়গায় জলপ্রপাতের রূপে শোন নদ নামে পাহাড় থেকে নীচে গভীর খাদে গিয়ে পড়ছে। এটি একটি ভিউ পয়েন্ট। ঘন জঙ্গল, পাহাড়ে ঘেরা স্থানটি বেশ সুন্দর।


এরপর গেলাম কপিলধারা। নর্মদা নদীর প্রথম জলপ্রপাত। নর্মদা এখানে প্রায় ১০০ ফুট নীচে ভূপতিত হচ্ছে। ভিউ পয়েন্ট আছে পর্যটকদের জন্য। কপিলধারা ছাড়িয়ে ঐ পাহাড়েরই নীচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মোটামুটি ১ কি.মি. গিয়ে দ্বিতীয় জলপ্রপাত, দুধধারা। জলপ্রপাতটি থেকে সাদা ধবধবে
জলরাশি ১০ ফুট নীচে আছড়ে পড়ে পাথরের উপর দিয়ে ঝিরিঝিরি শব্দে নিজের মনে বয়ে চলেছে।


মার্চ মাস বলে জল কম। তাহলেও সৌন্দর্যের ঘাটতি নেই। এই জায়গাটি ভারী চমৎকার। বৈচিত্র্যময়। চারপাশে ঘন জঙ্গল, উঁচু পাহাড়ে ঘেরা নদীর গতিপথ, মাথার উপরে উজ্জ্বল নীল আকাশ, নাম না জানা পাখিদের ডাক আর সঙ্গে বুনো, জংলী গন্ধ। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর। ফটো তোলার আগ্ৰহ হল না। মনের মধ্যেই বন্দী হয়ে রইল চারপাশ। ওখানেই পাশেই একটি পার্বত্য গুহা, দুর্বাসা গুহা। চুনাপাথরের গুহা। স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইটের দেখাও পাওয়া গেল সেখানে। এরপর এক কিলোমিটার চড়াই পথ। কোথাও সিঁড়ি, কোথাও বা পাথুরে পথ। সেই পথের সঙ্গী গাছপালা, পাখির ডাক আর কপিকুল। ক্যামেরার প্রতি তাদের মনোযোগ সাংঘাতিক।

আমার এই একটি দিনেরই সৌভাগ্য হয়েছিল অমরকন্টকে কাটানর। মন ভরে নি। অমরকন্টকের হাতছানি সমানেই অনুভব করি। দেখি কবে আবার সাড়া দিতে পারি!


*ছাত্রী, ১৯৮৯

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়