তোমার বাস কোথা হে পথিক, দেশে কি বিদেশে

০৯/০৯/২০১৬
জয়া ঘোষ

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি মার্কিনি রা সব ব্যাপারে এগিয়ে। সময়ের পেছনে ছুটছে এই দেশ। সময়ের পেছনে না হয় ধাওয়া করা যায় কিন্তু সময়কে ঠেলে পেছনে ফেলে, সময়ের আগে ছোটার আশ্চর্য ঘটনাটি এদেশে আসার আগে জানা ছিলনা। মার্কিন মুলুকে এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটে প্রতি বছর মার্চ মাসে। যখন বসন্ত দ্বারে এসে কড়া নেড়ে যায় তখন। হিসেব নিকেশে মার্কিনিদের জুড়ি  নেই। দেশের উন্নয়নের কথা ভেবে প্রয়োজনে প্রকৃতিকেও বশ মানাবার চেষ্টা করে থাকেন এঁরা। কিন্তু ঘড়ির কাঁটাকেও নিজেদের সুবিধামত নিয়ন্ত্রণ করেন এটা অনেকেরই অজানা।
এবার এগারোই মার্চ ঠিক মধ্য রাত্তিরে সেই বিস্ময়কর কান্ডটি আবার ঘটল। আমেরিকার সব ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে দেওয়া হল। ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে দেওয়ার এই প্রথা কে বলা হয় 'ডে লাইট সেভিং টাইম'(Day light saving Time). এই ধরুন আপনি ১০ই মার্চ রাত দশটায় শুয়ে আট ঘন্টা ঘুমোবেন মনে করে, ভোর ৬টাঅ্যালার্ম দিলেন। পরের দিন অ্যালার্ম বেজে উঠল নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগে। আপনার দেওয়াল ঘড়িতে  তখনও ভোর ৫টা। কম্পিউটার কিংবা ফোন অবশ্য নিজে থেকেই সময় সেট করে কিন্তু  নিজে হাতে দেয়াল ঘড়ি বা অন্যান্য ঘড়ির সময় 1 ঘন্টা এগিয়ে না দিলে কিন্তু মহা মুশকিল। অফিস যেতে অবধারিত দেরি । আক্ষরিক অর্থে ঘড়ির এক ঘন্টা এগিয়ে যাওয়া মানে এক ঘন্টা বেশি দিনের আলো উপভোগ করা বা সূর্যের আলোয় বাইরে  বেশি কাজ করতে পারা ঠিকই কিন্তু আসলে একঘন্টা ঘুমের সময় কমে যাওয়া। আর তাতেই বিপত্তিটা বাধে প্রথম কিছুদিন। 'আঙ্কেল স্যাম ' মানে সরকার ঘড়ির কাঁটাকে ঘাড় ধরে এগিয়ে এক ঘন্টা  প্লাস করলেন  আর ওদিকে আম জনতার বিশ্রামের পুরো ৬০ মিনিট  মাইনাস।  সময় যোগ করতে গিয়ে বিয়োগের বিভ্রান্তিতে জনগণ দিশাহারা।
এইভাবে মার্কিনীরা সময়ের আগে দৌড় করেন নভেম্বর মাস অবধি। ৪ই নভেম্বর কান ধরে সময়ের কাঁটাকে ১ ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হবে,আবার সেই পুরোনো সময় ফিরে পাওয়া,এক ঘন্টা বেশি ঘুমোনোর আনন্দ। সূর্যদেব শীতকালে একটু দেরিতে উদয় হন বলে মার্কিনিদের এই ব্যবস্থা।গ্রীষ্মকালের সকাল 6টা তখন আবার ভোর 5টা হয়ে যায়।
 প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় প্রাকৃতিক শক্তি (natural power) সঞ্চয় করার জন্যই শুরু করা হয় বছরে দুবার ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা করে এগোনো পিছোনোর  নিয়ম। যাতে করে বসন্তকালে দিনের আলো বেশি করে পাওয়া যায় আর শীতে এক ঘন্টা পিছিয়ে দিয়ে আবার সেই একঘন্টা ফিরিয়ে নেবার প্রথাকে বলা হয় 'ফল ব্যাক।' ২০০৫ সালের 'এনার্জি পলিসি আইন' (US energy policy act)-এই নিয়মকে সরকারী ভাবে বাধ্যতামূলক করেছে(হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ বাদে ) ।যদিও সেই সময় উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ শীত প্রধান শহর গুলিতে বরফে  ব্যাতিবস্ত মানুষ জন বসন্ত একটু আগে আসবে না পরে আসবে সেই জল্পনা কল্পনা করেই মনকে সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন। ট্রাডিশন অনুযায়ী ‘গ্রাউন্ড হগ ডে’ র (ground hog day) দিন যদি মেঘলা হয় তাহলে এরা মনে করেন স্প্রিং সময় মত আসবে আর যদি রোদ ঝলমলে দিনে গ্রাউন্ড হগ বা বেজি  নিজের ছায়া দেখে চমকে আবার গর্তে ঢুকে যায় তাহলে এদের ধারণা স্প্রিং আসতে ছয় সপ্তাহ আরো  দেরী ।  
বসন্তর আরেক নাম জীবন। জীবন চলমান, গতিশীল,। সেই গতিময়তা তুলনামূলক ভাবে আর পাঁচটা দেশের  থেকে বড্ড বেশী করে চোখে পড়ে মার্কিন মুলুকে। আমেরিকানদের কাছে  বসন্ত মানেই জীবন যুদ্ধে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার হাতছানি, সেই জন্যেই বোধয়  ঘড়ির কাঁটা এগনোর নিয়মকে এরা সাধারণ ভাষায় বলেন 'স্প্রিং ফরওয়ার্ড' অর্থাৎ এগিয়ে চলার নাম বসন্ত।
উত্তর গোলার্ধে ২১সে মার্চ বসন্তের শুরু। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে যখন বসন্ত এসে ধরা দেয় তখন সে তার সব উপাদান নিয়েই  হাজির হয়। নতুন পাতা,কচি ঘাস, ফুল,পাখি,মৃদুমন্দ বাতাস, ইস্টারের সময় কচি-কাঁচাদের অকারন চঞ্চলতা - বসন্তের সব উপাদানেই ভরপুর প্রবাসের  প্রকৃতি।   
টেক্সাসের জাতীয় ফুল ব্লু বনেট।  এই ফুলের বুনো গন্ধ আর উজ্জ্বল নীল ,বেগুনি রঙের শোভায় শুধু মানুষই নয় পোকা মাকড় ও আকৃষ্ট হয়। বুনো গন্ধে বর্ণে   rattle snake ও আসে।
দক্ষিণের দুএকটি রাজ্য ছাড়া  আমেরিকার বেশিরভাগ অঞ্চলেই শীত এত দীর্ঘ এবং তীব্র যে বরফে ব্যতিব্যস্ত মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে একটু উষ্ণতার জন্য।  যদিও শীতের জন্য এদের জীবনযাত্রার গতি খুব একটা রুদ্ধ হয়না কোন ভাবেই।  তবুও বসন্ত এলে বাইরের প্রকৃতিকে অনেক বেশি কাছ থেকে উপলব্ধি করা যায়। এপ্রিল মাসেও আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম বা উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলিতে বেশ ঠান্ডা থাকে। তাপমাত্রা ৫ থেকে ১৭ ডিগ্রির সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে।
যদিও উত্তর গোলার্ধে ২১ শে মার্চ হল বসন্তের প্রথম দিন কিন্তু সেই সময় এখানকার শীতপ্রধান শহর গুলিতে প্রায়ই তুষার ঝড় হয়। মনে পরে গেল আমার প্রথম বসন্তে, বরফের অভিজ্ঞতা। যেদিন আমার ঠিকানা বদলে গেল। কলকাতা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলাম মার্কিন মুলুকের  ডেট্রয়েটে। সময়টা ছিল এপ্রিলের শেষের দিকে। ক্যালেন্ডারের পাতায় বসন্তের আগমন ঘটে গেলেও তখনও শীত যাই যাই করে জানান  দিয়ে যাচ্ছিল তার উপস্থিতি। ভূগোল বইয়ের পাতায় দেখা লেক মিশিগানের নীল জলের দেশে শুরু করেছিলাম  জীবনের নব বসন্ত। সাত সমুদ্র পেরিয়ে সদ্য দেশ থেকে আসা এক আনাড়ি,স্প্রিং মনে করে গড়িয়াহাটের এক পাতলা সোয়েটার গায়ে পরে বাইরে বেরিয়েই টের পেয়েছিলাম কনকনে ঠান্ডা।
মিশিগানের প্রকৃতির শীতের সোহাগ ভরা শীতোষ্ণ বসন্তের সেই সাদর সম্ভাষণ কলকাতায় বসে কখনো আন্দাজ করা যায় না। বরফের চাদরে ঢাকা মাঠঘাট যেন এক স্বার্থপর দৈত্য। যার আগমনে অযথা প্রকৃতির বুকে নেমে এসেছে অশান্তির বাদল। ভরা পূর্ণিমার রাতে বরফের উপর ঠিকরে পড়া  চাঁদের আলোয় দেখেছি আশ্চর্য জ্যোতি। সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মাঝে  প্রতক্ষ করেছি সর্বশক্তিমানকে।  'প্রথম আদি তব শক্তি আদি পরমজ্জল, জ্যোতি তোমার গগনে গগনে'।
যদিও বাইরে হাড়হিঁম করা ঠান্ডা কিন্তু ভেতরে সেন্ট্রাল হিটিং/ কুলিং থাকে বলে একবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লে  আর কোন অসুবিধা নেই। স্কুল বাড়ি অফিস দোকান বাজার সব জায়গাতেই অভ্যন্তরীণ  তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে তার ফলে জীবনযাত্রার কোন অসুবিধা হয়না। নিউইয়র্ক শিকাগো,LA ,সানফ্যান্সিসকো ইত্যাদি বড় শহর গুলিতে যদিও কাজের জন্য লোকজনকে বাইরে যথেষ্ট হাঁটাহাটি করতে হয় কিন্তু বাদবাকি সব শীত অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে  অক্টোবর থেকে এপ্রিল অবধি লোকজন বাইরে খুব বেশি অকারণে বেড়ান না। গায়ে বিস্তর শীতবস্ত্র চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্কিং লট বা গ্যারাজে গাড়ি অবধি যেতে পারলেই হল। তারপর গন্তব্যে পৌঁছে 'চাঁচা আপন প্রাণ বাঁচা' বলে ভেতরে ঢুকতে পারলেই পেয়ে যাবেন উষ্ণতার অমূল্য রতন।
আমেরিকানরা অবশ্য ঠান্ডায় অভ্যস্ত। যত ঝামেলা  আমাদের মত শীতে কাবু ভিনদেশীদের। ভাগ্যবানেরা অনেকেই দেশে বা হাওয়াই  গিয়ে হাইবারনেট করে। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসে,শীতের সাথে 'কুছপরোয়া নেহি' চালে  বোঝাপড়াটা সেরে ফেলেন।
তুষারপাত হলে রাস্তায় বরফ গলানোর জন্য একধরণের নুন ছড়ানো হয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সল্ট ট্রাকগুলি চব্বিশ ঘন্টা তৈরী থাকে। বরফ পড়তে  শুরু করলেই রাস্তা ও পার্কিং লটগুলিতে নুন ছড়াতে শুরু করে ও ট্র্যাক্টর দিয়ে বরফ সরানোর কাজ চলে। মুশকিলটা হয় যখন সিটির ট্রাক্টর বাড়ি  থেকে বেরুবার রাস্তার ধারে বরফের স্তূপ জমা করেন। সকালে উঠে অফিস যাওয়ার সময় ড্রাইভ ওয়ের সামনে কৈলাস পর্বতের ন্যায় বরফের পাহাড় ভেদ করে  আপনাকে গাড়ি নিয়ে বেরোতে গেলে নেহাতই একটু বেশি  ক্যালোরি খরচ করতে হবে ! কোন ভাবে বেলচা দিয়ে বরফ সড়িয়ে রাস্তা করে আপনার পঙ্খীরাজ্ উড়িয়ে অফিসে পৌঁছে গেলেই হোল।
ফেরার পথে বরফ গলতে শুরু করলে আবার আরেক কেলো। কারন তখন বরফ গলে  জল হয়ে কালো পিচের রাস্তা বা পার্কিং লটের উপর স্বচ্ছ স্লিট হয়ে জমে গেছে যাকে  বলে ব্ল্যাক আইস আর অসাবধানে  সেখানে পা পড়লেই  ব্যাস একদম পপাত ধরণীতল !
মাঘের শীতে যেখানে বাঘ পালিয়ে যায় সেখানে কেন্টাকির জেলখানা থেকে একবার এক কয়েদি পালিয়ে ঠান্ডার হাত থেকে একটু উষ্ণতার আশায় আবার জেলেই ঢুকে পড়ে । 
সমগ্র মার্কিন মুলুকের প্রচন্ড বরফ অধ্যুষিত জায়গা গুলিতে ক্রিসমাসের ওই দশদিনের ছুটি বাদে শীতকালে রম রম করে স্কুল হয়। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছি টেক্সাসে। দক্ষিণের এই রাজ্যটি তে শীতের তীব্রতা নেই। কখনো যদি অল্প স্বল্প ফ্রস্টিং হয় তখন এরা একটু বেকায়দায় পড়ে যান। জলের পাইপ ফেটে যায় কিংবা রাস্তায় গাড়ির আক্সিডেন্ট হয়। বরফ পড়লে স্কুল ছুটি দিয়ে দেয় টেক্সাসে।
পশ্চিমের পৃথিবীতে বসন্ত  আসে একটু দেরিতে । শিমুল পলাশের বনে, রাঙা মাটির মেঠো পথে,বাউলের একতারাতে যখন ফাগুন এসে ধরা দেয় তখন মার্কিন মুলুকে উত্তরে বাতাসের নাছোড়বান্দা বেয়াড়াপনায়,ক্যালেণ্ডার বলে না দিলে বোঝা দায় তার উপস্থিতি। মার্চের শেষে কোথাও বাইরে বরফ বা বৃষ্টি। কোথাও  বিকেলের মৃদুমন্দ বাতাস, ভোরে পাখিদের  কলকাকলী কিংবা  ধূসর প্রকৃতির বুকে একটা দুটো কচি পাতার উঁকি ঝুঁকিকোথাও আবার  বরফ ঢাকা মেপল গাছের ডালে কার্ডিনালের শিষ
শহর পেরিয়ে শান্ত কোন পথের ধারে, ‘তখন আকাশ তলে ঢেউ তুলেছে পাখিরা গান গেয়ে,তখন পথের দুটি ধারে ফুল ফুটেছে ভারে ভারে’শুধু কবির বর্ণনায় নয়,সত্যি সত্যিই বসন্তের মোহন-মহিমায় প্রকৃতির পরম রমণীয়তা দৃশ্যময় ও স্পর্শময় হয়ে ওঠে সব জায়গায়। সে দেশেই হোক বা বিদেশে। সে দেখা দেয় সঠিক সময়ে সব দেশে,সব খানে।
“তোমার বাস কোথা হে পথিক, দেশে কি বিদেশে”........
````````````````````````````````````````````````````
*ছাত্রী, ১৯৮৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়