লকডাউন ও আমার এক টুকরো পৃথিবী
২০/১০/২০২০
মৌসুমী ব্যানার্জী*
২০২০ সালের
শুরুটা অন্যান্যবারের মতো
আনন্দ করে হলেও
জানুয়ারি মাসের
কয়েকটি দিন যেতেই
সমগ্ৰ পৃথিবী এক অদ্ভুত পরিস্থিতির
সম্মুখীন হল।
অজানা, অচেনা, অত্যন্ত
সংক্রামক নোভেল করোনা ভাইরাস,
কোভিড -১৯ বিশ্ববাসীর
দরজায় হানা দিল।
সমাজবদ্ধ জীব, মানুষের এই অদ্ভুত সংক্রামক বিভীষিকা থেকে বাঁচবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ এল "সামাজিক দূরত্ব" বজায় রাখবার জন্য। সংক্রমণ রুখতে দোকান, বাজার, স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, গণ পরিবহন সবকিছু বন্ধ করে ঘোষিত হল লকডাউন – গত একশো বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারতবর্ষও এই লকডাউনে সামিল হল ২৪ শে মার্চ , ২০২০ থেকে।
আমার বসবাস পশ্চিম উড়িষ্যার ঝাড়সুগুদা জেলার মফস্বল এলাকায়, নাম 'বন্ধবাহাল'। এই নামেই ডাকঘর বা পুলিশ ফাঁড়ি। ছোট, মাঝারি পাহাড়শ্রণী, ঘন সবুজ জঙ্গল, ছোট নাম না জানা নদী ছাড়াও কয়েক কিলোমিটার দূরেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি, মহানদীর ব্যাকওয়াটার। ইব নদীর উপত্যকায় Mahanadi Coalfields Ltd র বেশ কয়েকটি open cast mines ও workshop নিয়ে এই জনবসতি গড়ে উঠেছে।
![]() |
প্রকৃতির রাজ্যে বন্ধবাহাল, ইব নদী |
মফঃস্বল হলেও জায়গাটি অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই কয়লাখনির কয়লার যোগানের উপর নির্ভর করে NTPC ছাড়াও বেসরকারী বিভিন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, SAIL এবং আরোও বেসরকারী বেশ কিছু সংস্থা গড়ে উঠেছে যা অপরিহার্য পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। বাজার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান অবশ্য নিয়মের মধ্যে রেখেই সকাল ছটা থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আধবেলা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সড়ক পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দূরবর্তী গ্ৰাম থেকে আসা বিক্রেতাদের সমস্যায় পড়তেই হল। তবে পুরো অঞ্চলে পুলিশ কর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা বেশ চোখে পড়বার মতোই।
![]() |
| Open Cast Mine |
প্রকৃতি অকৃপণ হাতে এই অঞ্চলকে সাজিয়েছেন। দিগন্তবিস্তৃত চাষজমির পরেই হয়তো পাথুরে জমি বা কোথাও পাহাড়, কোথাও বা নদী বা জলাভূমি, কোথাও বা ঘন জঙ্গল। এর ফলে তুলনামূলক ভাবে মনুষ্য বসতি কম। একটি গ্ৰাম থেকে তার পার্শ্ববর্তী গ্ৰামের দূরত্ব অনেক বেশী। প্রকৃতি নিজেই এই সীমারেখা তৈরীতে সাহায্য করেছে। এই কারণেই লকডাউনের প্রথম দিকে এই অঞ্চল করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল।
দেশের অর্থনীতি তে
কয়লার ভূমিকা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। তাপবিদ্যুৎ
প্রকল্প গুলিকে
সচল রাখতে কয়লা উৎপাদন বন্ধ
রাখা অসম্ভব ব্যাপার।
ভারত সরকার দ্বারা
নির্দেশিত সতর্কতার
নিয়ম নীতি নিষ্ঠার
সঙ্গে মেনে উৎপাদন
প্রক্রিয়াকে সচল
রাখা হল।
Mahanadi Coalfields Ltd র তরফ থেকে প্রবেশদ্বারগুলিতে temperature gun, sanitizer র ব্যবস্থা রাখা হল। Mask পরা বিশেষ ভাবে বাধ্যতামূলক করা হল। Quarter complex র gate র নিরাপত্তা রক্ষীদের জন্যও একই সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হল। প্রতিটি quarter র নম্বর অনুযায়ী পরিচারিকাদের নাম, ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা নথিভুক্ত করা হল এবং প্রত্যেককে mask বিলি করে তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া quarter complex এ মাঝে মাঝেই নিজস্ব fog canon র সাহায্যে sanitizer spray করে নিরাপত্তা রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। Complex র মধ্যে children 's park ও বিশেষভাবে sanitize করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
![]() |
গ্ৰামবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ |
পশ্চিম উড়িষ্যার এই অংশে স্বাস্থ্য পরিষেবা একেবারেই উন্নত নয়। MCL এবং আরোও কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এই ব্যাপারে জায়গায় জায়গায় quarantine center ছাড়াও করোনা সংক্রামিতদের চিকিৎসার জন্য hospital তৈরীতে রাজ্য সরকারকে বিশেষভাবে সাহায্য করে চলেছে।
মানুষকে
সচেতন করবার জন্য
সম্পূর্ণ বন্ধবাহাল
এলাকার গ্ৰামবাসীদের মধ্যে
সুরক্ষা র
নিয়মবিধি প্রচার
করা হয়েছে। গ্ৰামগুলিকেও sanitize করে, গ্ৰামবাসীদের মধ্যে
mask , হাত ধোওয়ার সাবান
বিতরণ করে পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনীয়তা
বিশেষভাবে বোঝান
হয়েছে। ভিনরাজ্য
থেকে আসা মানুষজনকে
কঠোরতার সঙ্গে
home quarantine এ থাকতে
বাধ্য করা হয়েছে।
বাড়িতে সম্ভব না
হলে সতর্কতার সঙ্গে
quarantine center এ থাকাও
বাধ্যতামূলক করা
হয়েছে। লেখাপড়া না
জানা বা অল্প
শিক্ষিত গরীব
মানুষদের জন্য
home quarantine বিধি মেনে
চলবার জন্য বিশেষ
ব্যবস্থা ছাড়াও কোভিড
সংক্রামিতদের জন্য
রাউরকেল্লায় বা অন্যত্র রোগী পাঠানোর ব্যাপারে
স্থানীয় municipality ও যথেষ্ট
দায়িত্ব পালন
করে চলেছে। স্থায়ী দোকান বা
বাজারের বিক্রেতাদের
জন্যও sanitizer ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক
করা হয়েছে। Market complex র কাছাকাছি গাড়ি বা বাইক
নিষিদ্ধ করে
নির্দিষ্ট জায়গায়
গাড়ি রেখে পায়ে
হেঁটে বাজার, দোকান
বেশ কষ্টসাধ্য হলেও
মেনে চলতেই হচ্ছে।
সাইকেল আরোহীর প্রতি
কোনোও নিষেধাজ্ঞা অবশ্য
নেই। গত July মাস
থেকে রাজ্য সরকারের
নির্দেশে লকডাউনে
শিথিলতা আনা
হল। এর ফলে
সপ্তাহের পাঁচ
দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
ছাড়া অন্যান্য সব
দোকান সন্ধ্যা ছটা
পর্যন্ত খোলা
থাকছে। তবে দোকান, বাজার সপ্তাহান্তে
শনি ও রবি
দুদিন সম্পূর্ণ বন্ধ
রাখার নির্দেশ জারি
করা হয়েছে । নির্দেশিত নিয়মবিধি
লঙ্ঘনে প্রভূত পরিমাণ
অর্থদণ্ডের ব্যবস্থাও করা
হয়েছে শাস্তি রূপে।
![]() |
| Fog canon র সাহায্যে sanitizing |
![]() |
| গ্ৰাম sanitization |
এইভাবেই আমাদের এই ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি নিজের সুরক্ষার চেষ্টা করে চলেছে। Quarter complex র বাচ্চারা স্কুলে যেতে না পারলেও আজও তাই প্রতিদিন বিকেলবেলা বেশ কিছু সময় সবুজ প্রকৃতির কোলে আনন্দের সঙ্গে খেলাধূলায় কাটাচ্ছে। লকডাউনে এখানকার মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব হয় নি। যেহেতু কয়লা উৎপাদন বন্ধ করা হয় নি এর সঙ্গে জড়িত সকলের জীবন ও জীবিকায় তেমন ছন্দপতন না ঘটলেও অন্যান্য ব্যবসায় জড়িত মানুষ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন অবশ্যই। ঘরবন্দী প্রতিটি মানুষই সুন্দর রোগমুক্ত পৃথিবীর প্রতীক্ষায় থাকলেও প্রকৃতির বুকে আনন্দের জোয়ার।
সবুজে ঘেরা জায়গাটি
কিন্তু আরোও সবুজ
এখন। আকাশ আরোও
অনেক বেশী নীল।
নানারকম পাখির
ডাক সারা বছরই
মাতিয়ে রাখে। এখন
আরও অচেনা নতুন পাখির দল
প্রকৃতির আনন্দমেলায়
যোগ দিয়েছে। বৃষ্টির দিনে
রাস্তার ধারে
জমা জল কাঁচের
মতো স্বচ্ছ। পাহাড়,
নদী, জঙ্গল যেন
সমবেতভাবে লকডাউন
ঘোষণাকে স্বাগত
জানিয়েছে। জঙ্গলের বাসিন্দারাও
এমন শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে
বেজায় খুশী। কিছুদিন
আগেই এখানে একটি
পরিত্যক্ত quarter র মধ্যে থেকে
তাই বোধহয় উদ্ধার
হল ১৩ ফুট
লম্বা একটি অজগর
সাপ। বনকর্মীরা সযত্নে
তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে, গভীর জঙ্গলে
ফিরাবার দায়িত্ব
পালন করেছেন।
![]() |
| প্রকৃতি এখন আরও সবুজ |
প্রকৃতি এমন মনোমুগ্ধকর রূপে এর আগে কবে সেজে উঠেছিল আজকের মানুষেরা কেউ বলতে পারে না। মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদকে এখনকার কেউই এমন হাসতে দেখে নি এর আগে। আর অন্ধকার রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশের সঙ্গে এমন আলাপচারিতাও কি কেউ করতে পেরেছে এর আগে? প্রকৃতির প্রতি অত্যাচার করে নেশায় মেতে ছিল এতদিন। বারেবারে মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে নির্বিচারে বন জঙ্গল ধ্বংস করে আধুনিক সভ্যতার পত্তন ঘটাতে উদ্যোগী অহঙ্কারী সভ্য জগতের উদ্দেশ্যে আদিম, অকৃত্রিম প্রকৃতি নিজেই কি অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে? তাই কি এমন মৃত্যুমিছিল? তাই কি এমন হাহাকার ? তাই কি মানুষ আজ বাধ্য হয়ে গৃহবন্দী?
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব ,মানুষ! বিজ্ঞান, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্রহ্মাণ্ডকে জয়ের স্বপ্নে বিভোর তুমি! বিশাল গতিতে শুধুই ছুটে চলেছ ! কিন্তু ফিরে দেখো! নীল আকাশের দিকে চোখ মেলে চেয়ে দেখ ! অসীমতাকে অনুভব কর! কত উদারতা আকাশের বুকে! তুমি কি পার না অমন আকাশ হতে? সবুজ গাছপালা, জঙ্গলের মধ্যে সজীবতাকে অনুভব কর। ব্যস্ততা, প্রযুক্তি নির্ভরতা কি অমন সজীবতা দিতে পেরেছে তোমাকে! পাখি, প্রজাপতির ডানায় ভর করে তোমার স্বপ্নের দুনিয়ায় পা রেখে দেখো সূর্যের আলোকে সঙ্গী করে! ভোরের সূর্য বা আকাশে অস্তরাগের রঙ একটিবার এই অবসরে দেখে নাও । ঐ রঙে রাঙিয়ে নাও তোমার মন। আনন্দময় প্রকৃতির সন্তান তুমি ! মাতৃক্রোড়ে আজও তুমি নিতান্ত শিশু ছাড়া কেউ নও! মাতৃক্রোড়কে আর অবহেলা নয়। সাবধান হও আজই, এই মুহূর্ত থেকে। নয়তো পৃথিবী থেকে মুছে যাবে তোমার পরিচয়, তোমার শ্রেষ্ঠত্ব, তোমার সর্বস্ব!
*ছাত্রী ১৯৮৯










Darun laglo tomar lekha pore --- kato chintabhabna, tothyo aar koto barnona tumi ki sundor kore shajiye likhechho! -- Sudeshna Sanyal
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সুদেষ্ণা।
মুছুন'ঐ রঙে রাঙিয়ে নাও তোমার মন' - কি সুন্দর করে বলেছ ! ঝক ঝকে সবুজ ছবির সাথে তোমার লেখাও অন্তহীন সবুজের মতোই..খুব ভালো লাগলো পড়ে। - Kasturi Das
উত্তরমুছুনভারী চমৎকার তোমার মন্তব্য।
মুছুনProkriti o Corona ei dui er modhye bodhhoy sanghat nei... barong manusher bibechonaheen karjyokolap taake bishsmoy korechhe.. Corona manusher anek khoti korleo prokriti ke sanjibito korechhe..
উত্তরমুছুনTomar ashadharon lekha o chhobi r guun e ta protibhato..
ভালো লেগেছে বলে আনন্দ পেলাম দিদি।
মুছুন